কর্ম-যোগ: অতিমারিতে শহরে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। রাজাবাজারের একটি খাবারের হোটেলে দেখা মিলল তাদেরই এক জনের। ছবি: রণজিৎ নন্দী
বয়স মেরেকেটে ১৩-১৪। পাটকাঠির মতো চেহারা। দু’হাতে কড়া পড়ে গিয়েছে। চোখে-মুখে কালিঝুলি। পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি। সামনে ডাঁই করা লোহার ছাঁটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে সে। কী করছ? বার কয়েক প্রশ্নেও উত্তর নেই। একটু উঁচু গলায় ফের প্রশ্ন করতেই সে বলল, “কাজ করছি। কথা বলা যাবে না। কথা বলতে দেখলেই পিঠে মার পড়বে!”
লোহার ছাঁট কাঁধে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এমনই আর এক জনের আবার নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হাতের ছেনি-হাতুড়ি দেখিয়ে সে বলল, “ও আজ ৬টায় আসেনি। ওর মায়ের জ্বর এসেছে। দেরি করে এসে কাজের মধ্যে কথা বলতে দেখলে আজ ও শেষ। কথা বলা যাবে না।” এর পরে হিন্দিতে সে বলে, “ভাই জলদি কর, জলদি। হাত চালা।”
মল্লিকবাজারের লোহাপট্টিতে এ ভাবেই দিন কাটে এই দুই নাবালকের মতো আরও অনেকের। অনেকেই এসেছে অন্য রাজ্য থেকে। অধিকাংশই লোহার ছাঁট বাছাইয়ের কাজে যোগ দিয়েছে লকডাউনে স্কুল বন্ধ হওয়ার পরে। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খেটে কেউ পায় ২০০, কেউ বা ১৫০ টাকা। তার থেকেও ভাগ দিতে হয়, যিনি কাজে নিয়ে এসেছেন তাঁকে। একটু বেচাল হলেই টাকা তো মেলেই না, উল্টে জোটে বেধড়ক মার! শহর জুড়েই এমন শিশু-কিশোর শ্রমিকের সংখ্যা গত দেড় বছরে বেশ কয়েক গুণ বেড়েছে বলে অভিযোগ। এ রাজ্য তো বটেই, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা থেকেও অনেকে এ শহরে আসছে কাজের খোঁজে। গত মঙ্গলবারই যেমন এন্টালির একটি নির্মীয়মাণ বহুতল থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ বছরের এক কিশোরের। সে বিহারের কাটিহারের বাসিন্দা। তার বাবা ও কাকা নির্মাণকর্মী। স্কুল বন্ধ থাকায় সে-ও কাজের খোঁজে এ শহরে এসেছিল। যে দিন সে এ শহরে এসে পৌঁছয়, সে দিনই সতেরো তলা থেকে লিফটের গর্তে পড়ে তার মৃত্যু হয়।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কলকাতা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এই পরিস্থিতিতেই চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট লেবার (প্রহিবিশন অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্ট বা সিএএলপিআরএ আরও বেশি করে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। পাচার-বিরোধী বিলও দ্রুত পাশ হওয়া দরকার। গত সোমবার রাতেই ট্রেনে পাচারের সময়ে ২১টি বাচ্চাকে উদ্ধার করেছি আমরা।”
সিএএলপিআরএ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কমবয়সি কাউকে দিয়েই কাজ করানো যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা কিছু ক্ষেত্রে কাজে যোগ দিতে পারলেও একাধিক বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন, শারীরিক বা মানসিক ভাবে হানিকর কোনও কাজ করানো যাবে না। দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। তার মধ্যে এক ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে ওদের। একটানা তিন ঘণ্টার বেশিও কাজ করানো নিষিদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী, সকাল ৭টার আগে এবং সন্ধ্যা ৬টার পরে কোনও কিশোরকে দিয়েই কাজ করানো চলবে না। তাদের সপ্তাহে এক দিন ছুটি দেওয়াও বাধ্যতামূলক। এর অন্যথা হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে শ্রম দফতর। সে ক্ষেত্রে যে জরিমানা করা হবে, তা পাবে ওই কিশোর। এর পাশাপাশি, ওই কিশোরের যত দিনের সর্বনিম্ন মজুরি বকেয়া থাকবে, সেই টাকাটাও আদায় করে দেবে শ্রম দফতর। এর পরে উদ্ধার হওয়া শিশু বা কিশোরের নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি’ (সিডব্লিউসি)। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে তোলার পাশাপাশি ওই শিশু বা কিশোরের বাড়ির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে তারা। তত দিন তাকে সরকারি হোমে রাখা হবে। স্কুলে ভর্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করবে সিডব্লিউসি। পুলিশ তদন্ত করে গোটা বিষয়টির রিপোর্ট দেবে।
এত নিয়ম সত্ত্বেও বিধিভঙ্গ হয় কী করে? রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর মেলেনি টেক্সট মেসেজের। শ্রম দফতরের এক কর্তা যদিও জানিয়েছেন, দফতরের কর্মীরা শহরে নজরদারি চালাচ্ছেন। প্রায়ই নানা শিল্প এলাকায় হানা দেওয়া হয়। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিকও বললেন, “থানাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া আছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে একযোগে নানা জায়গায় হানা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের জ়িরো টলারেন্স।”
রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা গত দেড় বছর ধরে এ নিয়ে কাজ করে চলেছি। তবে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাস্তবে কতটা বাড়ল, স্কুল খোলার পরেই তা বোঝা যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy