ফিরহাদের গলায় অভিষেকের উল্টো সুর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রবীন্দ্র সরোবরে তালা ভেঙে ছটপুজোর ঘটনায় শাসক দলেরই দুই হেভিওয়েট নেতার গলায় ভিন্ন সুর। সর্বভারতীয় যুব তৃণমূলের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিষয়টিকে ‘গুন্ডামি’ হিসেবে দেখছেন, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তখন তাকে ‘ধর্মীয় ভাবাবেগ’ বলে সাফাই দিচ্ছেন।
দু’দিন আগে অর্থাৎ রবিবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর টুইটার হ্যান্ডল থেকে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘ধর্ম কারও ব্যক্তিগত হলেও, উৎসব সবার। মনে রাখতে হবে উৎসবের নামে গুন্ডামি চালালে গরিমা ক্ষুণ্ণ হবে ধর্মেরও। #ব্যথিত #ছটপূজা।’
পরিবেশকর্মীরা যখন রবীন্দ্র সরোবরের ছটপুজোর ঘটনাকে ‘ভোটপুজো’ বলে ব্যাখ্যা করছেন, তেমন একটা সময়ে অভিষেক ওই টুইট করে পরিস্থিতি কিছুটা সামলানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার সেই চেষ্টাতেই কার্যত জল ঢেলে দিলেন ফিরহাদ। তাঁর কথায়: “ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত এনে রবীন্দ্র সরবরে ছটপুজো বন্ধ করা ঠিক হত না। লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে সরাতে পারব না! এটা কি রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভব?’’ মন্ত্রীর এই মন্তব্য এ দিন ফের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ক্ষুব্ধ পরিবেশকর্মীরাও।
আরও পড়ুন: ৩৯ লক্ষ কি জলেই, প্রশ্ন পরিবেশকর্মীদের
এই মন্তব্য যে ফিরহাদই প্রথম করলেন, তেমনটা নয়। একই সুর দিন কয়েক আগে শোনা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। গত ৩১ অক্টোবর তিনি একটি জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দুর্গাপুজোর বিসর্জন, ছটপুজোয় গঙ্গার ঘাটে যেতে পারবে না বলে নির্দেশ এসেছে। তা হলে মানুষ যাবে কোথায়?’’ তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘আদালতের নির্দেশ আমি কখনওই অমান্য করি না। আমরা নতুন ১৫টি ঘাট করে দিয়েছি।’’ তবে এরই পাশাপাশি তিনি বলেছিলেন, ‘‘বহু সাধারণ মানুষ এ সব নির্দেশ সম্পর্কে জানতেই পারেন না। তাই কিছু মানুষ না জেনে-বুঝে অন্যত্র চলে গেলে কি পুলিশ দিয়ে লাঠি পেটা করব, নাকি গুলি করে মারব? ও সব পারব না। তার চেয়ে ভাল আমাকে গ্রেফতার করে রাখুন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর রবিবার অভিষেক ওই টুইট করেন। তার পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে জোরদার জল্পনা শুরু হয়ে যায়। ফিরহাদের এ দিনের ব্যক্তব্যের পর তৃণমূলের অন্দর থেকে উঠে আসছে, অভিষেকের টুইট যদি হিন্দিভাষীদের মধ্যে দলের কোনও ‘ড্যামেজ’ করে থাকে, সেটাই ‘কন্ট্রোল’ করার চেষ্টা হয়েছে। ফিরহাদ আসলে সেই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতেই এমনটা বলেছেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
মঙ্গলবার দূষণের জেরে টিয়াপাখি মারা গিয়েছে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। —নিজস্ব চিত্র।
তবে পরিবেশবিদরা ফিরহাদের এ দিনের বক্তব্যের সঙ্গে একেবারেই সহমত নন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে গুরুত্ব দেওয়ার থেকেও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিতেই রাজ্য সরকারের নজর দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তাঁরা। দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস রবীন্দ্র সরোবরে যে ভাবে আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে ‘তাণ্ডব’ চলেছে, পরবর্তী সময়ে মাছ-কচ্ছপ, এমনকি পাখিও মারা গিয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ পরিবেশপ্রেমীরা। জাতীয় পরিবেশ আদালতও বিষয়টি ভাল চোখে দেখছে না বলে জানিয়েছেন তাঁরা। যদিও ফিরহাদের বক্তব্য, “ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে মামলা না করে পরিবেশবিদদের উচিত মানুষকে সচেতন করা। তবেই মাধ্যমে সরোবরে ছটপুজো বন্ধ হবে।”
এ দিন কলকাতা পুরসভায় সাংবাদিক বৈঠকে রবীন্দ্র সরোবর প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, “সচেতনা বৃদ্ধির জন্যে আমরা প্রচার করেছি। ওই দিন কিছু মানুষ সরোবরে গিয়েছিলেন। তাঁরা সচেতন হলে, দেখবেন এক দিন ওখানে আর ছটপুজো হবে না। যাঁরা নিজেদের পরিবেশবিদ মনে করেন, তাঁরা আদালতে না গিয়ে যদি বস্তিতে বস্তিতে ঘুরতেন, তা হলে কাজ হত। আমরা দুঃখিত। আদালতের নির্দেশ অমান্য হয়েছে। কিন্তু, তৎপরতার সঙ্গে আমরা সরোবর পরিষ্কারের কাজও করেছি।”
ফিরহাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পরিবেশকর্মী নব দত্ত পাল্টা বলেন, “রাজ্য সরকারের যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, নির্দিষ্ট দিনে তা দেখা যায়নি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে, ধর্মাচরণের যুক্তি দেওয়া যায় না। সরকার কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি বলেই তো পরিবেশকর্মীরা আদালতে গিয়েছিলেন। কোনও নিষিদ্ধ জায়গায় তো যায়নি।”
Religion belongs to an individual but a festival belongs to all. Let’s not also forget that vandalism in the name of festival only makes the religion look dull. #Pained #ChhathPooja
— Abhishek Banerjee (@abhishekaitc) November 3, 2019
অভিষেকের টুইট।
আরও পড়ুন: লুঠ করল সব, তার পর সিমকার্ড আর কিছু টাকা ফেরতও দিয়ে গেল ‘মানবিক’ লুটেরা
ছটপুজোর পরে সরোবরের জলে মাছ-কচ্ছপের দেহ ভেসে ওঠার ঘটনা প্রসঙ্গেও এ দিন মন্তব্য করেন ফিরহাদ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রাকৃতিক নিয়মেই মাছ মারা যায়। রোগে মারা যায়। কালীঘাটের শ্মশানে প্রতি দিন কয়েকশো মানুষের দেহ নিয়ে আসা হয়। তা হলে কি বলব, দূষণের জন্য মানুষও মারা যায়!” রাজ্যের মন্ত্রীর এই মন্তব্যে রীতিমতো ক্ষুব্ধ পরিবেশবিদরা। নব দত্ত যেমন বলছেন, ‘‘মন্ত্রী দায় এড়াতেই এখন উল্টোপাল্টা বলছেন।’’ অন্য এক পরিবেশকর্মী সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “মাছ, কচ্ছপ মরেছে। মঙ্গলবার একটা টিয়াপাখিও মারা গিয়েছে। এতে যে জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে, ওঁরা কি সেটা বুঝতে পারছেন না?’’
রাজ্য সরকারের এই ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছে বিজ্ঞান মঞ্চ। আগামী কাল সকাল ৭টায় সমস্ত সচেতন মানুষকে তারা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে রবীন্দ্র সরোবরের সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy