পুরনো গাড়ি থেকে বেরোচ্ছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। শনিবার, চাঁদনি চকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’।— শুক্রবারই কলকাতা পুলিশের তরফে ফের এই নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছে, হেলমেট না পরলে তেল দেওয়া হবে না। আগামী মঙ্গলবার থেকে এই বিধি কার্যকর হবে। তার আগে করোনা সংক্রমণের কারণে ‘নো মাস্ক, নো ফুয়েল’, অর্থাৎ মাস্ক না পরলে তেল দেওয়া হবে না বিধিও চালু হয়েছিল।
অথচ কলকাতা ও হাওড়ার যান-দূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতীয় পরিবেশ আদালত এর আগে, সেই ২০১৫ সালেই প্রস্তাব দিয়েছিল ‘নো পিইউসি (পলিউশন আন্ডার কন্ট্রোল) সার্টিফিকেট, নো ফুয়েল’ নীতির। অর্থাৎ, গাড়ির দূষণ নিয়ন্ত্রণের ছাড়পত্র না দেখাতে পারলে তেল দেওয়া হবে না। তখন সেই প্রস্তাব নিয়ে একাধিক স্তর থেকে তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। শুধু ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-ই নয়, কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকও সেই বিরোধিতায় শামিল হয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, এই নীতি চালু হলে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। যদিও এই বিধি কেন প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা করে আদালত বলেছিল,— ‘দূষণ রোধে রাজ্য সরকারের দীর্ঘসূত্রতা এবং দায়িত্ববোধ ও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। তাই দূষণ রোধের ছাড়পত্র না দেখাতে পারলে তেল না দেওয়ার মতো পদ্ধতি বিবেচনা করা দরকার।’ যদিও বিরোধিতার চাপে ওই নীতি বাস্তবায়িত হয়নি। যার ফল, যানবাহনের দূষণে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গ!
যে ভাবে দূষণ বেড়ে চলেছে, তাতে এই বিধি চালু করা কি উচিত নয়? পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তুষার সেন বলেন, ‘‘এই বিধি চালু করা যাবে না। তবে দূষণ রোধে আমরা পদক্ষেপ করছি।’’
নথিভুক্ত মোট গাড়ির সংখ্যা
২০০১ সাল
দেশে: ৫ কোটি ৪৯ লক্ষ ৯১ হাজার
পশ্চিমবঙ্গে: ১৬ লক্ষ ৯০ হাজার
কলকাতায়: ৬ লক্ষ ৬৪ হাজার
২০১৫ সাল
সারা দেশে: ২১ কোটি ২৩ হাজার
পশ্চিমবঙ্গ: ৭৪ লক্ষ ৩ হাজার
কলকাতা: ১৪ লক্ষ ২ হাজার
(সূত্র: কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রক)
পুরনো গাড়ি বাতিল করা কতটা জরুরি, তা একাধিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। তাদেরই একটি সেন্টার অব সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, নিউ দিল্লি-র সমীক্ষা। যেখানে বলছে, কলকাতার রাস্তায় চলমান মোট গাড়ির ৬৫ শতাংশ ও বাণিজ্যিক গাড়ির ৯৯ শতাংশই ডিজ়েলে চলে। যে কারণে এ শহরের অন্য নাম ‘ডিজ়েল ক্যাপিটাল’। এই ডিজ়েলের ধোঁয়া ক্যানসারের একটি কারণ। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘তখন বলা হয়েছিল, মোটর ভেহিক্লস অ্যাক্ট, ১৯৮৮-র ১৩০ (১) ধারা এবং সেন্ট্রাল মোটর ভেহিক্লস রুলসের ১৩৯ রুলস অনুযায়ী, শুধু পুলিশই এই শংসাপত্র দেখতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ‘নো পিইউসি, নো ফুয়েল’ নীতি ফের বিবেচনা করা দরকার।’’
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ১২ বছর আগে, ২০০৮ সালে রাজ্য সরকার ‘ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট’ শিরোনামে এক নির্দেশিকায় ধাপে ধাপে ১৫ বছরের পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ি বাতিলের কথা বলেছিল। কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়েছিল, এই নির্দেশিকা বাস্তবায়িত হলে যান-দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা অনেকটাই সফল হবে। কিন্তু সেই নির্দেশিকা জারি বা কমিটি তৈরির ধারা এখনও চলছে। তা রাস্তায় পুরনো গাড়ির গতি রোধ করতে পারেনি! এক বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, ‘‘২০০৪ ও ২০০৮ সালে কলকাতা হাইকোর্ট গাড়ি-দূষণ রুখতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার জন্য রাজ্যকে একাধিক নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু এখনও সে সবের বাস্তবায়ন হয়নি।’’
মাস চারেক আগেও পরিবেশ আদালতে জমা দেওয়া হলফনামায় রাজ্য সরকার জানিয়েছে, পুরনো গাড়ি ধাপে ধাপে বাতিলের রূপরেখা তৈরির জন্য গত বছর ৪ ডিসেম্বর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়েছে। পরিবহণ দফতরের এক কর্তার দাবি, ‘‘চলতি বছরের মার্চের পর থেকে করোনা সংক্রমণের কারণে কমিটি বৈঠকই করতে পারেনি।’’ প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী তথা বর্তমানে রাজ্য সরকার গঠিত পরিবহণ কমিটির প্রধান মদন মিত্রের বক্তব্য, ‘‘বিষয়টা নিয়ে আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলব।’’
সংশ্লিষ্ট মামলার আবেদনকারী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘করোনা সংক্রমণ তো এসেছে কয়েক মাস। এত বছর ধরে পুরনো গাড়ির ধোঁয়ার বিষ যে শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকল, তার দায় কার?’’
সত্যিই তো দায়িত্ব কার?পরিবেশবিদেরা প্রায় ২১ বছর আগে এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষ আদালতের মন্তব্য মনে করাচ্ছেন,— ‘পরিবেশের অবনমন আসলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাই প্রকাশ করে।’
বিষ-ধোঁয়ার দায়িত্বও কি তবে রাজ্য সরকারেরই?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy