বিবিধ: প্রতিবাদের ভাষা অনেক। বৃহস্পতিবার, পার্ক সার্কাস ময়দানে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘ইনকিলাব আওয়াজ দো’ স্লোগান দিচ্ছিলেন হলুদ লং স্কার্ট, কমলা ফুলশার্টে মানানসই হলদেরঙা হিজাবধারী তরুণী। এর পরেই ঈষৎ ভাঙা বাংলায় ধরলেন, ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল’! মঞ্চের নীচে তালে তালে তখন হাততালি দিচ্ছে পার্ক সার্কাসের ‘মা ও কচিকাঁচাদের ব্রিগেড’।
সে সময়েই মঞ্চে বসে এই প্রতিবাদের চেনা মুখ আব্দুল জামিল, ইফতিকার হুসেনরা বলছিলেন, ‘‘পার্ক সার্কাসেও কিন্তু আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করছি।’’ একটু বাদে গান শেষে স্মিত মুখে সদ্য কলেজ-পাশ তরুণী ফিরদৌস এসে বলে গেলেন, ‘‘আমার স্কুলে বাংলা থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ ছিল তো! এটা নজরুলের গান, আমি জানি।’’
ঠিক একই সময়ে কোনও কোনও মহলে বিতর্কের সুর, কলকাতার প্রতিবাদ-মিছিলে বাংলার ছোঁয়াচ কি কমে যাচ্ছে? মাস দুয়েক ধরে নাগাড়ে শহরের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ-স্লোগানেও তো এখন ‘আজাদি’ বা ‘হল্লা বোলের’ রমরমা। সমস্বরে গান-কবিতাতেও পুরোভাগে ফইজ় আহমেদ ফইজ়ের ‘হম দেখেঙ্গে’ থেকে রাহত ইন্দৌরির ‘সভি কা খুন হ্যায় শামিল ইহাঁ কি মিট্টি মে’ কিংবা বরুণ গ্রোভারের ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’। “কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী? আমাদের বহু ভাষার দেশ, বিষয়টাও সর্বভারতীয়। সংবিধান রক্ষার লড়াই বলে অনেকে প্রতিবাদে তেরঙা হাতে নিয়েছেন, ঠিক তেমনই কোনও কোনও স্লোগান বা গান-কবিতা এখন ভাষার পক্ষপাত ছাড়াই প্রতিবাদের অস্ত্র।”— বলছিলেন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। পার্ক সার্কাসের মাঠ থেকে শুরু করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিরোধী নানা মঞ্চে সম্প্রতি দেশ-বিদেশের গান নিয়ে তাঁকে দেখা গিয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর দেশে বাংলার প্রতিবাদের পরম্পরায় বামপন্থীদের সাবেক তেভাগা আন্দোলন থেকে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরেও অজস্র বাংলা গান বা কবিতা গভীর ছাপ ফেলেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনা নিয়ে কবীর সুমনের বেশ কিছু গান পাড়ায় পাড়ায় বাজত। ছোট প্রকাশকের হাতে তৈরি জয় গোস্বামীর কবিতাগুচ্ছ ‘শাসকের প্রতি’ নন্দীগ্রাম-পর্বে তুমুল জনপ্রিয় হয়। অল্প সময়ে বেশ কয়েকটি সংস্করণও নিঃশেষ হয়েছিল। জয় কিন্তু প্রতিবাদের ক্ষেত্রে কোনও একটা ভাষার আধিপত্য সঙ্কীর্ণ ভাবে দেখতে রাজি নন। তিনি বলছেন, “ভাষা নয়, প্রতিবাদের সময়ে কাজটাই গুরুত্বপূর্ণ। ফইজ়ের কবিতার কথা বা ভাবটাই আসল।” জয় মনে করেন, ‘‘মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে একটা ভাষা বেছে নেওয়া হচ্ছে। ভারতীয়দের মুখে সেই ভাষা শোভা পাচ্ছে, এটাই বড় কথা।” তবে সর্বভারতীয় প্রতিবাদের আঙ্গিকে বাংলা একেবারে উপেক্ষিত, তা-ও বলা যাচ্ছে না। কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী টিএম কৃষ্ণ যেমন জনগণমন অধিনায়ক-এর মূল গানটির অপেক্ষাকৃত অপরিচিত স্তবকগুলি দেশ জুড়ে গেয়ে বেড়াচ্ছেন, গাইছেন ডি এল রায়ের ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি’! রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র ইংরেজি রূপও প্রতিবাদীরা অনেকে আবৃত্তি করছেন।
দক্ষিণ ভারতে আজাদির স্লোগানেরও তামিল বা মালয়ালমে রূপান্তর ঘটেছে। বাংলায় এখনও সে চেষ্টা তত জমেনি। সিএএ বিরোধী প্রতিবাদে দলিত-আন্দোলনের নানা স্লোগান পাল্টে অনেকেই ‘জয় রোকেয়া’ বা ‘জয় মাতঙ্গিনী, জয় সুভাষ, জয় ভীম’ বলছেন অবশ্য। “কিন্তু বাংলার মূল স্রোতের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী-লেখকেরা কি সিএএ-এনআরসি নিয়ে খুব বেশি গান-কবিতা তৈরি করছেন? না কি এখনও ভয় পাচ্ছেন, বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মুখ খুললে অনুরাগী কমে যাবে?”— প্রশ্ন রেডিয়োর সঞ্চালক-অভিনেতা সায়ন ঘোষের। সায়নদের কয়েক জনের তৈরি এনআরসি-বিরোধী ‘জিঙ্গল বেলের’ প্যারোডি ভিডিয়ো অবশ্য বড়দিনের সময়ে অনেকেই দেখেছেন।
প্রবীণ কবীর সুমনের বাঁধা নতুন গান ‘যেখানে রুটি যেখানে ভাত, সেখানে দিন সেখানে রাত, সেখানে থেকে যাই’ সদ্য পার্ক সার্কাসের মাঠে গাওয়া হয়েছে। তবে নজর কাড়ছে অখ্যাত প্রতিবাদীদের সৃষ্টিশীলতা। স্থানীয় সংস্কৃতি অঙ্গনের তালিমে রাজারহাটের স্কুলপড়ুয়া সাহিনা, আমরিনদের সহজ-সরল বাংলা গানের সুর পার্ক সার্কাস মথিত করছে। আদতে কাশ্মীরি পরিবারের নওশিন বা আইনের ছাত্রী মেটিয়াবুরুজের শাফকত রহিমেরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘তোমার বুকে নাথুরাম, আমার বুকে ক্ষুদিরাম’ বলে। শাফকত বলছিলেন, ‘‘আরও বেশি মানুষকে কাছে টানতেই আমরা চাইছি বাংলাতেও নতুন স্লোগান-গান আসুক প্রতিবাদের মাঠে।’’
আবার প্রতিবাদের ভাষার খোঁজে মৌসুমী ভৌমিকেরা শাহিন বাগের ‘দাদিদের’ বলিরেখাদীর্ণ মুখে জোন বায়েজ়ের গানের ‘পৃথিবীর ক্লান্ত মায়েদের’ দেখছেন। পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদীরা ডাকছেন, ভাষা দিবসে সকলে আসুন। নিজের ভাষায় প্রতিবাদের কথা, গান মেলে ধরুন! ভাষার সঙ্গেও তো আসলে সম্পর্ক পাল্টায়, সেটাই বলছে এ বারের একুশের স্পর্ধা। বহুমুখী প্রতিবাদের সূত্রে বহুভাষী ভারতেরই হাত ধরছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy