উদ্যাপন: বাড়ির ছাদেই ছট পালন। বুধবার, টবিন রোডে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
জলাশয়ে ছটের বচ্ছরকার পার্বণ নিয়ে নানা আপত্তির আবহে এ যেন উলটপুরাণ! অতিমারির সঙ্কটে গঙ্গার ঘাটে বা স্থানীয় জলাশয়ে ‘ছটি মাইয়া’-কে অর্ঘ্য দানের বিকল্প রাস্তাও উঠে আসছে কলকাতার বিহারী সমাজে।
সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ে কুলোয় সম্ভার সাজিয়ে গঙ্গায় না-গেলে ফাঁকা লাগবে ঠিকই। কিন্তু পরিবারে শীতল ছায়া দেওয়া বটগাছ, মায়ের জীবনের থেকেও কি তা বড় হতে পারে? তাই ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মা মালতীদেবী এ বারও কাশীপুরের সর্বমঙ্গলা ঘাটে যাবেন শুনে বেঁকে বসেন পুত্র কুসুমকুমার দ্বিবেদী। “না মা, এখনও কোভিড রয়েছে। তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়ও কম নয়! কিছুতেই তোমাকে যেতে দেব না!”
শুনে মা, বৌয়েরা কাতর, “তুই কি জানিস, ছটি মাইয়ার কাছে আমাদের কত কী মানসিক করা আছে। ও সব বললে হবে!” অতএব বাড়ির মেজো ছেলে, পুলিশের দুঁদে ইনস্পেক্টর তথা মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা আধিকারিক কুসুমকুমারকে মাথা খাটিয়ে বিকল্প রাস্তা ভাবতে হয়েছে। বুধবার, ছটের তৃতীয় দিনে টবিন রোডের কাছে দ্বিবেদীদের বাড়িতে সেই চেষ্টারই নমুনা দেখা গেল। খোলা ছাদে বিকেল তিনটের আগেই বড় টবে গঙ্গাজল ঢেলে তৈরি প্রবীণ গৃহকর্ত্রী মালতী। তাতে গোড়ালি-ডোবা জলে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে কুলোয় ফল, ঠেকুয়ার অর্ঘ্য হাতে পর পর বয়স মেনে দাঁড়ালেন বাড়ির বৌয়েরা। মোবাইলে পরিবারের এমন স্মরণীয় ছবি তুলতে তুলতে কুসুমকুমারের কন্যা, সেন্ট জ়েভিয়ার্সের প্রথম বর্ষ রিতিকা উচ্ছ্বসিত, “এই তো চাই। কোভিডের সময়ে সচেতনতার দিকটাও ভুললে চলবে না!”
নিউ টাউনের বাসিন্দা, রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার তথা প্রবীণ আইএএস সৌরভ দাসের স্ত্রী নীতাও খাস পটনার মেয়ে। কলকাতায় গত ১৭ বছর ধরে গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে কিংবা বাড়ির কাছের পুকুরে ছট পালন করছেন। তিনিও এ বার সকাল-সন্ধে কোনও নদীতটে না-গিয়ে নিজেদের বাড়ির ছাদেই নিষ্ঠা ভরে ব্রত পালনের রীতি মেনে নিয়েছেন। ভবানীপুরের বাসিন্দা, হোটেল ব্যবসায়ী অরবিন্দ সিংহের পরিবারও ছাদে ছট পালনের রীতি আঁকড়ে ধরেছে। এ রাজ্যে রাষ্ট্রীয় বিহারী সমাজের চেয়ারম্যান হরীন্দ্র সিংহের হিসাব বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দু’কোটি বিহারীর বসবাস। তাঁদের অর্ধেকই ছট পালন করেন। তাঁর কথায়, “এ বছর কিন্তু অতিমারির বিপদ বুঝে আমরাই ‘ছট ছাত পর ইয়া ঘর পর’ ডাক দিয়েছি।” বাস্তবে অবশ্য এই আহ্বানের সবটা অনেকেই কানে তোলেননি। হেস্টিংসের তক্তাঘাটে ছট উৎসবের উদ্বোধন হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। কিন্তু সচেতন নাগরিকদের অনেকেই এ বার নদীবিমুখ। প্রবীণ আইএএস-কর্তা সৌরভ দাস বলছেন, “গঙ্গায় বা কোনও পুকুরটুকুরে ছটে স্নান করতে হবে, এমন কোনও নিয়ম নেই। সামান্য জলে সূর্যের সামনে দাঁড়ালেই চলবে।” একটু খোলা জায়গা পেলে ভাল। ‘ছটি মাইয়া’ সূর্যের বোন বলে কথিত। কেউ বলেন, তিনি বেদের ঊষাদেবী। পুলিশ অফিসার কুসুমকুমারও দেখেছেন, পশ্চিমবঙ্গেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় কোনও জলাশয় না-থাকলে ছটের ব্রত পালনে ইটে ঘেরা ছোট চৌবাচ্চায় দাঁড়ানোর রেওয়াজ। লেকে ছট বন্ধ হওয়ায় আশপাশেও কিছু চৌবাচ্চা করা হয়েছে। মালতীদেবীর বাবা-মায়ের বাড়ি সিওয়ান জেলার রাজনপুরায় গঙ্গার নামগন্ধও নেই। অস্থায়ী জলাশয়তেই প্যান্ডেল খাটিয়ে ধুমধাম করে ছট পালন চলে। প্রবাসী বিহারীরাও কারও ব্যক্তিগত সুইমিং পুলে বা নানা রকমের অস্থায়ী আয়োজনেই ব্রত রক্ষা করেন। কলকাতায় এ বারও যেমন কেউ কেউ বাড়ির ছাদে করেছেন। পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “নদীতে ছটের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও তাতে ফুল, লতা, তেলে নদীর দূষণ হয়েই থাকে। ছাদে বা অন্যত্র জল রেখে ব্রত পালন যে কোনও পরিস্থিতিতেই সচেতনতার প্রকাশ। এমনটা বছর, বছর চললেই তো ভাল হয়!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy