দাদুর কোলে অনুভব। (ডান দিকে) তিন বছরের শিশুটির মা-বাবা, শিখা ও সঞ্জয় মণ্ডল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী এবং সংগৃহীত
জিভের ক্যানসারের সঙ্গে তার মায়ের লড়াইটা চলছিল কিছু দিন ধরেই। তবে সেই লড়াইয়ে তার মাকে হারিয়ে দেয় করোনা। ছেলেকে বড় করার যুদ্ধ একাই শুরু করেছিলেন শিশুটির বাবা। কিন্তু তা-ও বেশি দিন স্থায়ী হল না। তাঁকেও ছিনিয়ে নিল করোনা!
কোভিডে দশ মাসের ব্যবধানে বাবা-মা দু’জনকেই হারানো, তিন বছরের অভিনব মণ্ডলই শহরের এক দুর্গাপুজো কমিটির এ বারের মুখ। বালিগঞ্জ সমাজসেবী সঙ্ঘ নামে ওই পুজোর উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, শিশুটির ভবিষ্যতের সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিচ্ছেন তাঁরা। প্রথম লক্ষ্য, তাকে ভাল স্কুলে ভর্তি করানো। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা অরিজিৎ মৈত্র বলছেন, ‘‘শুধু এই শিশুটিই নয়, পুজোর বাজেট কমিয়ে পাশে দাঁড়াব বলে এমন ১০টি বাচ্চা খুঁজছি, যারা করোনায় আপনজনকে হারিয়েছে। যাদের ভবিষ্যৎ বড় প্রশ্নের মুখে।” নিজের পরিবারের সদস্যকে করোনায় হারানোর পরে তাঁর মেয়ের কথা ভাবতে গিয়েই ভাবনাটা এসেছে।
এ রাজ্যের ২৭টি শিশু করোনায় অনাথ হয়েছে বলে দিনকয়েক আগেই সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি বড় রাজ্যে বাস্তবে এই সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়ার কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে, ‘‘অনাথ শিশুদের দেখভাল করার কেউ নেই। আমাদের দায়িত্ব ওদের রক্ষা করা। শিশুরা যাতে তাদের অধিকার পায়, সেটি দেখা।’’ সেই অধিকারের প্রশ্নে একটি পুজো কমিটি এগিয়ে এলেও সরকারি সাহায্য অনুভব কি পেয়েছে? বাবা-মায়ের অবর্তমানে অনুভব যার কাছে মানুষ হচ্ছে, সেই কলেজপড়ুয়া মাসি, অনিতা দাস বললেন, ‘‘আর কেউ তো সাহায্য করতে আসেননি। বেশি কিছু চাই না। শুধু চাই ছেলেটা ভাল স্কুলে ভর্তি হোক। ওকে ভাল কোথাও পড়ানোর টাকা আমাদের নেই।’’
বালিগঞ্জের পেয়ারাবাগান বস্তির ছোট্ট ঘরে দাদা আর মায়ের সঙ্গে থাকেন অনিতা। আসবাব বলতে ছোট্ট চৌকি। তার নীচেই চলে রান্না-খাওয়া। অনিতা বলে চলেন, ‘‘২০১৫ সালে জামাইবাবু সঞ্জয় মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার মামার মেয়ে শিখার। ছোট বয়সেই মামিমা মারা গিয়েছিলেন। আমার মায়ের কাছেই ওই দিদি মানুষ। লেক রোডে সঞ্জয়দাদের বাড়ি। জামাইবাবু গাড়ি চালাতেন। ভালই চলছিল সংসার। অনুভবের যখন আড়াই বছর বয়স, দিদির ক্যানসার ধরা পড়ে।’’ খানিক চুপ থেকে অনিতা জানান, একাধিক হাসপাতাল ঘুরে শুরু হয় শিখার ক্যানসারের চিকিৎসা। কেমো চলছিল। তার মধ্যেই গত বছর সেপ্টেম্বরে জ্বর হয় শিখার। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করার কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যান। করোনা পরীক্ষায় দেখা যায়, শিখার রিপোর্ট পজ়িটিভ।
অনিতা জানান, সেই ধাক্কা কোনও মতে সামলে ওঠার চেষ্টা করছিলেন জামাইবাবু। গত জুলাইয়ে হঠাৎ জ্বর হয় তাঁর। সঙ্গে প্রবল শ্বাসকষ্ট। পাড়ার ডাক্তার তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেন। শম্ভুনাথ পণ্ডিতের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হলেও সেখানেই গত ২৮ জুলাই মৃত্যু হয় তাঁর।
অনিতার পাশে দাঁড়ানো তাঁর মা, বছর পঞ্চান্নের পার্বতী দাস বলে ওঠেন, ‘‘এর পর থেকে বাচ্চাটা আমাদের কাছেই। ওর মাকেও ছোট্ট থেকে মানুষ করেছি, এ বার ওকে করছি।’’ গলা বুজে আসে প্রৌঢ়ার। নিজেকে কোনও মতে সামলে নিলেন অনুভবের চিৎকারে। তার তখনই খেলনা চাই। নানা রঙের গাড়ি বার করে দিতে দিতে পার্বতী বললেন, ‘‘লোকের বাড়ি কাজ করে ওর জন্য সব ব্যবস্থাই রাখার চেষ্টা করি। এ ছেলের তেমন বায়না নেই। খাসির মাংস হলে আর কিছু চাই না। তবে মাঝেমধ্যেই মা-মা করে ওঠে। তখন ভুলিয়ে রাখার হাতিয়ার ওই খাসির মাংস!’’
বেরিয়ে আসার সময়ে অনুভবের মাসি, দিদিমা আবারও বলেন, ‘‘কিচ্ছু চাই না। শুধু ওকে ভাল স্কুলে ভর্তি করাতে চাই। ওর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, ছেলে ভাল স্কুলে পড়বে। দেখতে পারল না। অন্তত মায়ের দেওয়া অনুভব নামটা স্কুলের খাতায় উঠুক..!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy