Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

পার্কিং কাকুদের কোলেই যুদ্ধের প্রস্তুতি দুর্গার

মহালয়ার দিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিল ওই শিশুকন্যা। তাই দুর্গা ছাড়া তার জন্য আর কোনও নাম ভাবতে পারেননি শুভানুধ্যায়ীরা।

শৈশব: এ ভাবেই লোহার গ্রিল ঘেরা জায়গায় শুয়ে থাকে দুর্গা। গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে। নিজস্ব চিত্র

শৈশব: এ ভাবেই লোহার গ্রিল ঘেরা জায়গায় শুয়ে থাকে দুর্গা। গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে। নিজস্ব চিত্র

সুনীতা কোলে, দেশকল্যাণ চৌধুরী শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৯ ০২:৩১
Share: Save:

দুপুরে খাওয়ার সময়। স্থান গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে। ঝোল দিয়ে মাখা ভাত একরত্তি শিশুকন্যাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন মা। তার অবশ্য ভাত খেতে প্রবল আপত্তি। শিশুটির মাথা নাড়ার চোটে ভাত পড়ে নোংরাই হয়ে গেল সদ্য স্নান করিয়ে পরানো হলুদ ফ্রক। পাশ থেকে ভাত খাওয়ায় তাকে উৎসাহ দিতে লোকের অভাব নেই। স্থানীয় দোকানের কর্ত্রী থেকে পার্কিং অ্যাটেনড্যান্ট— অনেকেই নজর রেখেছিলেন খুদের উপরে। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে আদর-খুনসুটি উপভোগ করে হাসিমুখে ফের কাজে মন দিচ্ছিলেন তাঁরা।

মহালয়ার দিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিল ওই শিশুকন্যা। তাই দুর্গা ছাড়া তার জন্য আর কোনও নাম ভাবতে পারেননি শুভানুধ্যায়ীরা। দুই ফুটপাতবাসীর সন্তান দুর্গারও বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠাঁই হয়েছে গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে। সেখানকার পার্কিংকর্মীরা জানাচ্ছেন, দুর্গার মা সোনালি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। অনেক সময়েই তাঁকে নির্দেশ দিতে হয় কী ভাবে মেয়ের যত্ন নিতে হবে। দুর্গার স্নান বা খাওয়ার সময় হল, কখনও কখনও তা-ও মনে করিয়ে দিতে হয়।

দুর্গার বাবা বিশ্বনাথ দত্ত তেমন কোনও কাজ করেন না। অনুষ্ঠানবাড়িতে ফাইফরমাশ খাটা বা মালপত্র বয়ে দেওয়ার মতো কাজ যখন যেমন পান, তা থেকেই সামান্য আয় হয়। বিশ্বনাথ মাদকাসক্ত বলেও জানাচ্ছেন পার্কিংকর্মীরা। তাই ছোট্ট দুর্গাকে চোখে-চোখে রাখাটাও এখন তাঁদের রোজনামচার অঙ্গ। কাজের ফাঁকে দুর্গাকে কোলে নিয়ে ঘোরেন তাঁরা। কখনও আবার তাঁদের ব্যাগ রাখার লোহার গ্রিল ঘেরা জায়গায় নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে পুঁচকে। দুর্গার অসুখ-বিসুখেও পাশে দাঁড়ান তাঁরা। কিনে দেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। এর জন্য খরচাপাতি ভাগ হয়ে যায় ১৮ জন কর্মীর মধ্যে।

কেন ওই শিশুকন্যার দেখভাল করেন তাঁরা?

কাটজুনগরের বাসিন্দা, পার্কিংকর্মী তীর্থঙ্কর দাস বলেন, ‘‘জন্মের পর থেকেই তো দুর্গাকে দেখছি। মায়া পড়ে গিয়েছে। আমারও এই বয়সের মেয়ে রয়েছে বাড়িতে। সবাই মিলে যতটা পারা যায়, করি আমরা।’’ আর এক কর্মী অজয় লোহানি বলেন, ‘‘যতটা খেয়াল রাখা দরকার, ওর বাবা-মা সব সময়ে পেরে ওঠেন না। তাই আমরাও নজর রাখি। এই জায়গাটা তো তেমন ভাল নয়।’’ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জন্ম হওয়ায় দুর্গার জন্মের শংসাপত্র রয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে পোলিয়োর টিকাও দেওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্বনাথ। দুর্গার বয়স এখন আট মাস। সাত মাস বয়সে সকলে মিলে তার অন্নপ্রাশনের আয়োজন করেছিলেন।। সে দিন মামার ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী।

দুর্গা বড় হলে তার পড়াশোনার কী ব্যবস্থা হবে? এই প্রশ্নই আপাতত চিন্তায় রেখেছে তার বাবা-মা থেকে শুরু করে শুভানুধ্যায়ীদের। আদরের দুর্গাকে ফুটপাতের জীবন থেকে দূরে, একটা অন্য জীবন উপহার দেওয়ার ইচ্ছে সকলেরই। আর তার প্রথম ধাপ হিসেবে তাঁদের পরিকল্পনা, কোনও ভাল আবাসিক স্কুলে ভর্তি করাবেন দুর্গাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি যেখানে মিলবে সুস্থ পরিবেশও। নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসিক স্কুলের সন্ধানে তাই পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। তার আগে অবশ্য পাখির চোখ দুর্গার এক বছরের জন্মদিন। চার মাস দেরি থাকলেও জন্মদিন পালনের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে এখন থেকেই। অজয় বলেন, ‘‘যাই খাওয়ানো হোক, জন্মদিনটা কিন্তু বড় করে পালন করতেই হবে।’’

তাকে ঘিরে এত পরিকল্পনার কিছুরই অবশ্য খোঁজ রাখে না দুর্গা। হাত-পা নেড়ে সে তখন ব্যস্ত এক পার্কিংকাকুর ছদ্ম বকুনির জবাব দিতে। অজস্র দোকানপাট, যানজট, মানুষের ভিড়ের মাঝে চোখ টানে দুর্গার মুখের অমলিন হাসিটুকু। যেন সে জানে, জীবনের যুদ্ধে তার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তার মাসি-পিসি-মামা-কাকারা।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Footpath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy