চোখের সামনে গড়ে উঠতে দেখা সল্টলেক-রাজারহাটের অতীতকথায় অনেকেই হয়তো আশ্চর্য হবেন। অথচ দমদমের ক্লাইভ হাউস থেকে ভোজেরহাটের তারদা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ, পর্তুগিজ ও দেশীয় রাজা-জমিদারদের পদচিহ্নের মতোই নগরায়ণের রথের নীচে চাপা পড়ে গেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে, সশস্ত্র বিপ্লবে বা উন্নয়নে স্থানীয় মানুষের ত্যাগের কথা।
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে নিয়ে যে সব মিউনিসিপ্যালিটি গড়া হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল ‘ইস্ট সুবার্বন মিউনিসিপ্যালিটি’ বা মানিকতলা পৌরসভা। এই পৌরসভা দিয়ে কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের শুরু। পশ্চিমে সার্কুলার খাল আর পুবে নিউকাট ক্যানালের (বর্তমান ই এম বাইপাস) মধ্যবর্তী এলাকা হওয়ায় ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্ব ছিল বেলেঘাটা, নারকেলডাঙা, ফুলবাগান, কাঁকুড়গাছি, উল্টোডাঙা, দক্ষিণদাঁড়ি অঞ্চলের। বহু বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবার বসতি গড়েন এখানে। বড় শিল্পের পাশাপাশি কাঁকুড়গাছিতে ‘যশোরের চিরুনি’র মতো ঐতিহ্যবাহী ছোট শিল্প স্থাপন করে সফল হওয়া মন্মথনাথ ঘোষের কথা ক’জনই বা মনে রেখেছেন? কিংবা রবীন্দ্র-স্নেহধন্য প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কৃষ্ণপুরে দ্বিতীয় শান্তিনিকেতন রূপে গড়ে তোলা ‘পল্লীভারতী’ আশ্রমের কথা? ১৯৩৪ সালে শুরু যে আশ্রম, তার জমি ষাটের দশকে বেদখল হয়ে যায়, অপমৃত্যু ঘটে একটি স্বপ্নের।
অবশ্য নতুন স্বপ্ন খুঁজে নেওয়া গেছে স্বাধীনতা-উত্তর সল্টলেক গড়ে তোলার সরকারি উদ্যোগে। কিন্তু তথ্য বলে, বহু আগেই এই এলাকাকে নগরায়ণের বৃত্তে আনার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। ১৮৬৫ সালে সে লক্ষ্যে একটি সংস্থাও গঠিত হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত জটিলতার কারণে তার রূপায়ণ হয়নি। বরং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক বিকল্প মডেল প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় মৎস্যজীবী ও ভূমিপুত্ররা। আজও বিদ্যাধরী স্পিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি-র নামে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কার্যালয়ের ধ্বংসস্তূপ তার সাক্ষী। রাজারহাট উন্নয়নের জাঁকজমকের তলায় বিদ্যাধরী নদীর ক্রমহ্রাসমান প্রবাহের মতো গুরুতর বিষয়ের সঙ্গে এলাকার ইতিহাস নিয়ে চর্চাও চাপা পড়েছে। প্রাচীন পরিবারগুলির ও স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষের ত্যাগের কথা উঠে আসেনি উন্নয়নের আলোচনায়।
সেই ঘাটতি মিটবে পিপল’স গ্রিন সোসাইটির গবেষণায় এবং দেশকাল-এর প্রকাশনায় দুই খণ্ডে প্রকাশিতব্য ইস্ট সুবার্বন ও সল্টলেক: নগর কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত এবং রাজারহাট ও নিউ টাউন: নগর কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত বই দু’টি থেকে। মৌমিতা সাহার গ্রন্থনায় ও শ্যামলকুমার ঘোষের সম্পাদনায় বহু দুর্লভ ছবি, মানচিত্র, পুরনো রিপোর্ট, পারিবারিক ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক তথ্যে ভরা এই গবেষণা শহরের পূর্ব প্রান্তের ইতিহাস তুলে ধরেছে। ভূমিপুত্রদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা এই বই দু’টির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ আগামী ২১ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায়, রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে। ছবিতে গঙ্গা থেকে ড্রেজিং করে পলিমাটি এনে লবণহ্রদ ভরানোর দৃশ্য, বই থেকে।
সার্ধশতবর্ষে
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, যশোর, হুগলি, নদিয়ার গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল কালাজ্বর নামের এক মারণব্যাধি। লিশমানিয়া গণভুক্ত এক প্রকার প্রোটোজ়োয়া এই রোগের সংক্রমণ ঘটায়। বেলেমাছির কামড়ের ফলে এই রোগ সংক্রমিত হতে থাকে, সে সময় মৃত্যু হয় হাজার হাজার মানুষের। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (ছবি) ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (পরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) গবেষণা করে ইউরিয়া স্টিবামাইন ঔষধ আবিষ্কার করেন, অগণিত মানুষের জীবন বাঁচানোয় যা ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আগামী ১৯ ডিসেম্বর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হবে, দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল ও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের সেমিনার হলে এক অনুষ্ঠানে স্মরণ করছে তাঁকে, তাঁর গবেষণা ও জীবনকৃতির আলোচনায়।
বরেণ্য
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর জন্মদিন এগিয়ে আসছে, ২৯ ডিসেম্বর। এ বছরই তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তিও। সেই আনন্দময় উপলক্ষই রূপ পেল দু’দিন ব্যাপী উদ্যাপনে, গত ৯-১০ ডিসেম্বর অবন মহলে। ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী-র আয়োজনে অনুষ্ঠান ‘ছন্দে বরণে গানে’: বিশিষ্টদের সম্মান-শ্রদ্ধার্পণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল বিশেষ নিবেদন, শঙ্খ ঘোষের গদ্য অবলম্বনে নির্মিত গীতি-আলেখ্য ‘গান আর ধর্ম’। ছিলেন প্রমিতা মল্লিক জয়তী চক্রবর্তী অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। দ্বিতীয় দিন ‘ঠাকুরবাড়ির গান’ শোনাল ছোটরা, দোলনা স্কুল ও ইন্দিরা-র ছাত্রছাত্রীরা; ‘সুপূর্ণা স্মৃতি’র ছাত্রছাত্রীরা গাইলেন রবীন্দ্রগান।
জরুরি কথা
ধর্ম সমাজ ও রাজনীতির সম্পর্ক সমসময়ের এক চর্চিত বিষয়। ধর্মকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজ যে ভাবে আলোড়িত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা থেকে দেশভাগেও তা শেষ হয়নি। এই সম্পর্ক ফিরে দেখার তাগিদে, সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃতি অনুধাবনে জরুরি যুক্তি ও তথ্য-আশ্রয়ী আলোচনা। সেই লক্ষ্যেই কাউন্সিল ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ় কলকাতা ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ উদ্যোগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সভাকক্ষে গত ৩০ নভেম্বর হয়ে গেল জাতীয় আলোচনাচক্র। মূল ভাষণ দেন অধ্যাপক ও সমাজকর্মী রাম পুনিয়ানী, হিন্দুত্বের ধারণা প্রবল হয়ে ওঠার বিপদকে সমাজ রাজনীতি ইতিহাসের আলোয় বোঝালেন তিনি। কথা হল দুই বাংলায় সংখ্যালঘু অবস্থান, উপমহাদেশের দেশপ্রেমী মুসলমানদের নিয়েও।
ছোট ছবির বিশ্ব
নামে ছোট, প্রভাবে নয়। ‘ছোট ছবি’র বিপুলা পৃথিবী থেকে মণিমুক্তো বেছে এনে, এক ছাদের তলায় তাদের সাজিয়ে তোলে কল্পনির্ঝর ফাউন্ডেশন, গত দু’দশক ধরে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে শহরে চলছে ২১তম ‘কল্পনির্ঝর শর্ট ফিকশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, গ্যোয়টে ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায়, ম্যাক্সমুলার ভবনে। ‘বিশ্বের ছবি’ বিভাগে স্পেনের ‘নাভারা শর্টজ়িনেমা’-র ছ’টি সাম্প্রতিক ছবি-সহ নানা দেশের ৩৩টি ছবি, প্রতিযোগিতা বিভাগে ১২টি ভারতীয় ছবি: সব মিলিয়ে ১৬টি দেশের মোট ৪৫টি! আজ উৎসবের শেষ দিনে বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে হ্যাপি উইমেন’স ডে, আ বিট অব হ্যাপিনেস, মাসি, সদাবাহার, আ টাইগার টেল দেয়ারফোর, ইট স্মেলস লাইক রেন, চোরিওয়ালি কহানি, ব্রোকেন ওয়াল ছবিগুলি, ৭টায় পুরস্কার ঘোষণা ও জয়ী ছবির প্রদর্শন।
শতবর্ষে স্মরণ
কাজী নজরুল ইসলামের কাছে শিখে তাঁরই পরিচালনায় গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪৩-এ, সে বছরেই আকাশবাণীতে গাওয়া শুরু। স্নেহ ও শিক্ষা, দুই-ই পেয়েছেন পঙ্কজ মল্লিকের। পাহাড়ী সান্যাল রেণুকা দাশগুপ্ত মঞ্জু গুপ্ত সুবিনয় রায় শুভ গুহঠাকুরতা রাজ্যেশ্বর মিত্রও শিক্ষাগুরু সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের। একটানা পনেরো বছর গান শিখিয়েছেন দক্ষিণীতে, অধ্যাপনা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও। আত্মপ্রচারহীন, শিল্পীবন্ধু সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের শতবর্ষ (১৯২৩-২০০৬) পালনে এগিয়ে এসেছে কালীঘাটের রবীন্দ্রচর্চা ভবন। ২২ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায় ভবনে অনিরুদ্ধ সিংহের উদ্যোগে ওঁর স্মরণে থাকবেন পবিত্র সরকার স্বপ্না ঘোষাল অভিরূপ গুহঠাকুরতা প্রমুখ, গান গাইবেন এই সময়ের বিশিষ্ট শিল্পীরা।
খেয়াল স্রোতে
শিল্প মানেই কি গম্ভীর ভাবনা, জটিল নির্মিতি? খেয়ালখুশির রস লুকিয়ে আমাদের মনের গভীরে, তার প্রকাশ কি হতে পারে না শিল্প-অভিজ্ঞতা? প্রায় দু’দশক ধরে সেরামিক্স নিয়ে কাজ করছেন তমাল ভট্টাচার্য, বারুইপুরে বেনের চাঁদনি বাসস্টপের কাছে ‘স্টুডিয়ো ক্যালিক্স’ ওঁর বাড়ি ভাবনাঘর কর্মশালা সবই। তমাল ও তাঁর শিল্পীবন্ধুরা— সুস্মিতা চিত্রালী উদয় মৃন্ময়ী মেখলা প্রধি শ্রীপর্ণা শ্রেয়সী কথা রানি— গত কয়েক মাস ধরে সেখানেই মগ্ন ছিলেন সুকুমার রায়কে ঘিরে। ব্যাপারখানা কী? আবোল তাবোল-এর শতবর্ষ এ বছর, কে না জানে। সেরামিক্সের শিল্পকাজে ওঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন এক-একটি ‘আবোল তাবোল’ ভাবনা: ‘দেহের ওজন উনিশটি মণ/ শক্ত যেন লোহার গঠন’ বা ‘আপনাকে আজ আপন হতে/ ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে’ (ছবি)। আজ শুরু, ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত, দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা এই প্রদর্শনী দেখা যাবে স্টুডিয়ো ক্যালিক্সে। খেয়ালরসের শিল্প!
সুশি-খুশি
‘সুশি’ এখন পরিচিত বাঙালি খাদ্যরসিক-মহলেও। সিজ়নড রাইস, নানা ধরনের মাছ, মাছের ডিম, শাকসব্জি দিয়ে সুশি তৈরিতে দক্ষতা রন্ধনশিল্পীদের বহু প্রজন্মের অর্জন। জাপানের প্রাচীন সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের দূতও সে। ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে বহু যুগ ধরে পানকৌড়ি পাখির সাহায্যে ‘আয়ু’ মাছ ধরা থেকে শুরু করে ভাত ও মাছের প্রক্রিয়াকরণ হত নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে; ঊর্ধ্বতনকে সম্মান প্রদর্শনে সুশি উপহারের প্রথা ছিল। আধুনিক কালে ভিনিগারের আবিষ্কার ও দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির প্রভাবে সুশি তৈরির পরম্পরায় বদল এলেও তার জনপ্রিয়তা কমেনি। অতীত-বর্তমানের সেতুবন্ধ সে। সুশি-কেন্দ্রিক খাদ্য-সংস্কৃতি জানার সুযোগ করে দিয়েছে জাপানের কনসুলেট জেনারেল, ভারতীয় সংগ্রহালয় ও জাপান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রদর্শনী ‘আই লাভ সুশি’ (ছবি), ২ ডিসেম্বর থেকে চলছে ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রিহিস্টরিক গ্যালারিতে। আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সোমবার বাদে সকাল দশটা থেকে সন্ধে ছ’টা।
ভারতপথিক
৪ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক উদ্যোগে, উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের সহায়তায় ১৮২৯ সালের ওই দিন সতীদাহ-প্রথা রদে আইনসিদ্ধ উদ্যোগ গৃহীত হয়। রামমোহনের জীবনেও দিনটির গুরুত্ব কিছু কম নয়, তাঁর পরিচালিত সম্বাদ কৌমুদী-র আত্মপ্রকাশ এ দিনেই। দিনটি মনে রেখে ও রামমোহন রায়ের জন্মের আড়াইশো বছর উপলক্ষে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে স্মরণগ্রন্থ ভারত-পথিক’এর (সম্পা: শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়) আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল জীবনানন্দ সভাগৃহে, গত ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। রামমোহন বিষয়ে আধুনিক গবেষকদের লেখা, সেই সঙ্গে মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি সৈয়দ মুজতবা আলী বেণীমাধব বড়ুয়া রজনীকান্ত গুহ যোগানন্দ দাস প্রমুখের রচনাও চয়িত আন্তরিক আয়াসে। বললেন শ্যামলকুমার সেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্নাত দাশ প্রমুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy