Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
মুখ্যমন্ত্রী তোলা ও কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলেছেন। নেতাদের ‘রোজগার’ এ বার বন্ধ হবে কি?

ফুটপাত চাই? দর হাঁকছেন দাদারা

অনেকেরই অভিযোগ, শহরের ফুটপাতগুলিও তোলাবাজির বড় আখড়া। দুর্ঘটনা ঘটলে নেতা-মন্ত্রী থেকে শহরের মেয়র— সকলেই ফুটপাত দখলমুক্ত করার আশ্বাস দেন। 

বেহাত: দোকানের দখলে গড়িয়াহাটের ফুটপাত। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

বেহাত: দোকানের দখলে গড়িয়াহাটের ফুটপাত। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০১:১৫
Share: Save:

এক ক্রেতা আর এক নেতাকে নিয়ে ভবানীপুরের ফুটপাতে হাজির মধ্যস্থতাকারী। ফিতে দিয়ে ফুটপাত মেপে তিনি বললেন, ‘‘দশ ফুট বাই সাত ফুট। মানে, মোট ৭০ স্কোয়ার ফুট। চার হাজার করে কথা হয়েছে। মানে দু’লাখ আশি হাজার।’’

বিস্মিত ক্রেতা বললেন, ‘‘কী বলছেন দাদা! ফ্ল্যাট কিনতেও তো এত টাকা দিতে হয় না। থাকার জায়গার থেকে ফুটপাতের দাম বেশি!’’ প্রবল বিরক্ত নেতা মধ্যস্থতাকারীকে বললেন, ‘‘কথা বলে আনতে পারিস না! দাম ছেড়ে দিলাম। স্টল পেতে এমনিই স্কোয়ার ফুট পিছু বাড়তি পাঁচ হাজার করে দেওয়ার জন্য লোকে বসে আছে।’’

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের নেতা-কর্মীদের কাটমানি ও তোলাবাজি বন্ধ করে অসৎ উপায়ে নেওয়া টাকা ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরেই জেলার পাশাপাশি এ শহরেও বিভিন্ন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কাটমানি খাওয়া নিয়ে গানও বেঁধেছেন এক শিল্পী। অনেকেরই অভিযোগ, শহরের ফুটপাতগুলিও তোলাবাজির বড় আখড়া। দুর্ঘটনা ঘটলে নেতা-মন্ত্রী থেকে শহরের মেয়র— সকলেই ফুটপাত দখলমুক্ত করার আশ্বাস দেন।

কিন্তু বাস্তব চিত্রটা বদলায় না। ব্যবসা চলতে থাকে নেতা ও দাদাদের তুষ্ট রাখার সুবাদে।

দক্ষিণ কলকাতার বড় অংশেই আবার ফুটপাত ব্যবসায় ‘প্যাকেজ সিস্টেম’ চলছে বলে জানাচ্ছেন হকারেরা। সেই ‘প্যাকেজ’-এ স্টলের জন্য লোহার কাঠামো এবং আলো-পাখার বন্দোবস্ত রয়েছে। এ ছাড়া, ‘প্যাকেজ’-এ ঢুকলে বসার টুল এবং টেবিলের জন্য প্রতি মাসে আর ভাড়া দেওয়ার ব্যাপার থাকে না। গড়িয়াহাট, গোলপার্ক ও ভবানীপুরের ফুটপাতে প্রতি বর্গফুট জায়গার ‘দাম’ এখন কার্যত ফ্ল্যাটের দামের থেকেও বেশি। গড়িয়াহাট হকার্স ইউনিয়নের এক নেতার কথায়, ‘‘এককালীন দামের পাশাপাশি থাকে প্রতিদিনের চাঁদা। হাত ঘুরে ওই টাকা কোন পর্যন্ত যায়, তা আমরাও আন্দাজ করতে পারি না।’’

নেতাদের টাকা তোলার আর একটি পদ্ধতির কথা শোনালেন নারকেলডাঙা মেন রোডের এক হকার। তাঁর কথায়, ‘‘কাউকে নতুন দোকান পাততেই দেওয়া হয় না এখন। পুরনোদের সঙ্গে প্রতিদিন দোকান পাততে ১০০ টাকা করে দিতে বলা হয়েছে। তবে সময়ে সময়ে সেই রেট-ও বদলে যায়।’’ ওই ব্যবসায়ীর দাবি, নেতার লোক এসে ডেকে নিয়ে যান। তার পরে মোবাইল জমা রেখে ঘরে বসিয়ে মুখোমুখি হন নেতারা। ওই দোকানির কথায়, ‘‘নেতা বলেন, ‘তোমার তো এখন ভালই বিক্রিবাটা হচ্ছে। এক রেটে আর ক’দিন?’ যিনি প্রতিদিন ১০০ টাকা করে দেন, তাঁকেই বলে দেওয়া হয়, সামনের মাস থেকে ২০০ টাকা করে দিতে। প্রতিবাদ করলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। দোকান রাখতে এঁদের শুরুতেই এক লক্ষ টাকা দিতে হয়েছে। এর পরে ব্যবসা তুলে দেওয়া যায়?’’

উল্টোডাঙায় সম্প্রতি হকারদের জন্য ফুটপাতে স্থায়ী স্টল তৈরির অভিযোগ ওঠে পথচারীদের সমস্যার কথা না ভেবেই। স্টলগুলির গায়ে আবার নেতা-মন্ত্রীদের ছবি। সেখানকার এক ফল ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘প্রথমে ভাবি, এ সব ভোটের জন্য। পরে বুঝলাম, টাকা কামানোর ফিকির। তবে এত বেশি টাকা চাইবে, ভাবিনি।’’ ওই হকারের দাবি, স্টল-পিছু জনপ্রতিনিধিদের চার-পাঁচ লক্ষ টাকা করে দিতে হয়েছে। বাগুইআটি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজারের পুরোটাই আবার তোলার টাকায় চলছে বলে অভিযোগ। সেখানে দোকান পাতার ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে আলো জ্বালানোর তোলা আলাদা। মিটিং-মিছিলের জন্য টিফিনের ব্যবস্থাও করতে হয় দোকানিদের। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘আমরা কোথা থেকে টাকা দেব? বাধ্য হয়ে ওজনে কারচুপি করি।’’

বেলেঘাটা খালপাড়ে হকারদের জন্য স্থায়ী স্টল তৈরি করে মোটা টাকা কামানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। বাইপাসে তোলার টাকায় নেতাদের রেস্তরাঁ চলছে বলেও অভিযোগ। উত্তর কলকাতা যুব তৃণমূলের নেতা জীবন সাহা অবশ্য বললেন, ‘‘কোনও স্টল বিক্রি হয়েছে বলে তো জানি না। কেউ কাটমানি খাচ্ছে দেখলেই অভিযোগ জানাব!’’ উল্টোডাঙা মেন রোডের তৃণমূল পরিচালিত হকার্স ইউনিয়নের নেতা রবি পাল আবার যুব তৃণমূলের উপরেই দোষ চাপিয়ে বলেন, ‘‘কারা টাকা খান জানি না। আমরা খাই না। পুরনো তৃণমূলের কেউ টাকা খাওয়ার লোক নন। নতুনদের খোঁজ করা ভাল।’’

এত দিন পরে কেন খোঁজের কথা? সে উত্তর অবশ্য নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Corruption Bribe Hawker Footpath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy