Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: সোনায় সোহাগা

১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি কিশোরপাঠ্য পত্রিকায় প্রকাশ পায় দুই কিশোর বন্ধু নন্টে আর ফন্টের কাণ্ডকারখানা, সাদাকালো বই আকারে প্রথম প্রকাশ ১৯৮১, ডিসেম্বর।

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ০১:১৯
Share: Save:

বাংলা কমিকসের জীবন্ত বিস্ময় নারায়ণ দেবনাথের তিন জনপ্রিয় কমিকস সিরিজ় হাঁদাভোঁদা (১৯৬২), বাঁটুল দি গ্রেট (১৯৬৫) এবং নন্টে ফন্টে (১৯৬৯)। ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কমিকস সৃষ্টি করে তিনি আমাদের বিস্মিত করেছেন। এই তিনটি কমিকস সিরিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও চিত্ররূপ সবই তাঁর একার হাতে তৈরি। এমন নজির বিশ্ব কমিকসে খুব বেশি নেই। হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল ইতিমধ্যেই অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত করেছে, এ বার পালা নন্টে ফন্টের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি কিশোরপাঠ্য পত্রিকায় প্রকাশ পায় দুই কিশোর বন্ধু নন্টে আর ফন্টের কাণ্ডকারখানা, সাদাকালো বই আকারে প্রথম প্রকাশ ১৯৮১, ডিসেম্বর। এদের প্রথম দিকের কাহিনিচিত্রে হাঁদা ভোঁদার মতো একে অপরের পেছনে লাগার প্রবণতা দেখা গেলেও মনোরঞ্জন ঘোষের ‘পরিবর্তন’ উপন্যাসের অনুপ্রেরণায় নন্টে ফন্টে কমিকসে যোগ হয় মজার সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার ‘পাতিরাম হাতি’-সহ (প্রথম আবির্ভাব ১৯৭১) বোর্ডিং স্কুলের কাণ্ডকারখানা। এর পরে আসে কেল্টুদা (১৯৭২)।

সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে কমিকস প্রেমীরা সদ্য পালন করেছেন অ্যাস্টেরিক্সের ষাট বছর কিংবা লি ফকের অরণ্যদেবের চুরাশিতম জন্মদিন সেখানে কিছুটা হলেও বাংলা কমিকস উদাসীন এই শহরে এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস করতে চলেছে দীপ প্রকাশন। তাদের উদ্যোগে নন্টে ফন্টের প্রথম প্রকাশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ সংগ্রাহক সঙ্কলন ‘নন্টে ফন্টে সোনায় সোহাগা’ (পরিকল্পনা ও সম্পাদনা তিয়াসা সেনগুপ্ত) গ্রন্থ প্রকাশ হতে চলেছে ২৯ মার্চ, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোরে পাঁচটায়। স্মারক সঙ্কলনটিতে রয়েছে মূল সাদাকালোয় ছাপা প্রথম নন্টে ফন্টে, প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের আবির্ভাব, প্রথম কেল্টুদা কমিকস-সহ, হারিয়ে যাওয়া নন্টে ফন্টের মূল প্রচ্ছদগুলি, ‘জাগৃতি’ সিনেমার দৃশ্যের অনুপ্রেরণায় তৈরি কমিকস প্যানেল, পৃথক কাহিনিচিত্রে নন্টে ফন্টের ক্যামিয়ো প্রবেশ-সহ (অতিথি চরিত্র হিসাবে উপস্থিতি) বেশ কিছু নির্বাচিত সেরা কমিকস। ভূমিকা লিখেছেন কমিকস অনুরাগী সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায়। প্রচ্ছদ বিল্টু দে। সঙ্গের ছবিতে নারায়ণ দেবনাথ।

শক্তিহীন

উত্তম-সুচিত্রা বা হেমন্ত-সন্ধ্যার মতো তাঁদের জুটি পঞ্চাশের দশকের পর ষাট-সত্তর দশক মাতিয়েছিল। তাঁরা— সুনীল-শক্তি। ১৯৯৫-এর ২৩ মার্চ হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানের আকস্মিক বিদায়ের পর আনন্দবাজার পত্রিকাতেই সুনীল লিখেছিলেন, ‘টিলার ওপর থেকে শক্তিকে উড়তে দেখেছি।’ এর পরে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘শক্তি’ নামের মনখারাপের কবিতা। শঙ্খ ঘোষ রচনা করেছিলেন সেই গদ্য— ‘এই শহরের রাখাল’। উৎপলকুমার বসু রচনা করেছিলেন, ‘আমাকে নাচতে দাও গো।’ জয় গোস্বামীর ‘শোকযাত্রার প্রতিবেদন’ আজও সেই শোকরাতুল কলকাতা শহরের কথা মনে পড়ায়। জাঁ ককতো-র মৃত্যুর পর যেমন শোকমলিন হয়ে উঠেছিল প্যারিস শহর। এ বারও ২৩ মার্চ এল। শহর ‘শক্তিহীন’ ২৫ বছর। যদিও লিখতে এসেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’। তাঁর মৃত্যুর পর ‘পদ্যসমগ্র ১’-এর ভূমিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘অর্থের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে ঝাড়াহাতপা হয়ে কবে যে শক্তির সোনার তরীতে উঠে বসেছিলাম, আজ আর মনে নেই। আমার কাছে পারানির কড়ি ছিল না। তবুও।’’ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ আর সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’-এ প্রায় একই সঙ্গে দুটি কবিতা লিখে (কবিতা না কি পদ্য!) তাঁর নিরুপম আবির্ভাব। তারও পরে— দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ এবং ফুটপাথ বদল হবে মধ্যরাতে। তত দিনে তিনি ‘স্বেচ্ছাচারী’। গভীরতম অন্ধকারময় জলজ দর্পণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘জলে ভেসে যায় কার শব!’ ১৯৯৫-এর ২৩ মার্চ তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’। তিনি তো জানতেনই এবং লিখেও জানিয়েছিলেন— ‘আমাকে পোড়াও’। তবু কী আশ্চর্য! আজও যে কোনও কবিতা-আসর বা আড্ডার ‘স্মৃতির ভিতর’ শক্তিই রয়ে গিয়েছেন।

সংগ্রহ নিয়ে

‘চিত্রশিল্পের সৃষ্টিই হয় সংগ্রাহকদের জন্য,’ বলছিলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত, ‘পরে সেটি স্থান পেয়েছে রাজপ্রাসাদ, বিত্তবানের গৃহ বা কোনও সংগ্রহশালায়।’ তাঁর মতে সংগ্রহশালার সংগ্রহ এসেছে মূলত দান, ক্রয় বা কোনও বিশিষ্ট মানুষের দেওয়া উপহার হিসেবে। তবে নানা কারণে এ দেশের বহু মূল্যবান সংগ্রহ চলে গিয়েছে বিদেশে। গত ১৪ মার্চ সন্ধেয় রাজ্য চারুকলা পর্ষদ-এর আয়োজনে অবনীন্দ্র সভাঘরে ‘শিল্পকলা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ’ শীর্ষকে বলছিলেন তিনি। এ বারের নন্দলাল বসু স্মারক বক্তৃতায় স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে বিশেষত চিত্রকলা কী ভাবে প্রসারলাভ করেছিল এবং তা সংগৃহীত বা সংরক্ষিত হয়েছিল তারই একটি বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, ভারতীয় সংগ্রহশালা, আশুতোষ সংগ্রহশালা বা গুরুসদয় সংগ্রহশালার কথাও। প্রতি বারের মতো এ বারেও এই বক্তৃতাটি প্রকাশ পাবে পুস্তকাকারে। সূচনায় পর্ষদের পক্ষে তাপস কোনার বলছিলেন, ‘কোলাহল থেকে দূরে যেতে শিল্প বড় আশ্রয়। এ দিকে, গুরুসদয় সংগ্রহশালার অবস্থা সঙ্কটজনক, অ্যাকাডেমি সংগ্রহশালা বন্ধ দীর্ঘ দিন। কিন্তু এ ভাবে আর কতদিন!’ স্মারক বক্তৃতায় প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকে না, কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন সংগ্রহশালা নিয়ে সাধারণ মানুষের নানাবিধ সদুপদেশ এবং অসন্তোষের কথা উঠে এল এখানে। কলকাতার একটি সংগ্রহশালার টিকিট সম্পূর্ণ অনলাইন করে দেওয়া নিয়ে আপত্তির কথাও শোনা গেল!

কথামানবী

কলকাতা শহরে তখন চালু হয়ে গিয়েছে— যে কোনও কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের শেষে আসব পান। পঞ্চাশের দশকের কবি-লেখকদের সঙ্গে অবলীলায় নব্বই দশকের কবিরা ‘সোনালি তন্দ্রাহরণী’তে মিশে যেতে পারতেন। যেতেনও। কিন্তু রাত গড়ালেই বিশেষ করে তরুণদের প্রত্যেকের কাছে কাছে গিয়ে ধমকধামক। এমনকি হাত থেকে পানীয়ের পাত্রটি কেড়ে নিয়ে খাবার খেয়ে নেওয়ার কথা বলতেন সম্ভবত এবং একমাত্র তিনিই— মল্লিকা সেনগুপ্ত। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিদারুণ নিয়তি তাঁকে ২০১১-য় ডেকে নিয়ে যায় কর্কট রোগের অছিলায়। এই রকমই এক নিদাঘ বসন্তের ২৭ মার্চ তাঁর জন্ম। সেই উত্তাল ষাটের দশকের ছাত্র-আন্দোলনের গোড়াতেই। ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। এমনকি নিদারুণ রোগ-জর্জরিত অবস্থাতেও তিনি তাঁর গ্রন্থে, শব্দে-বাক্যে জানিয়েছিলেন, ‘আমাকে সারিয়ে দাও ভালবাসা’। ‘সানন্দা’ পত্রিকায় দীর্ঘ দিন কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করেছেন। যত না প্রবীণ, তার চেয়ে অনেক বেশি নবীন কবিমুখ তুলে এনেছিলেন তিনি এ পত্রিকারই কবিতা পাতার মধ্যে দিয়ে। তাঁর ‘সীতায়ন’ নিয়ে শহর কলকাতার সাংস্কৃতিক জগৎ যে কী বিপুল পরিমাণে উদ্বেলিত হয়েছিল, আজ তা ইতিহাস। সে দিনের শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছিলেন বা জবাবদিহি করেছিলেন, ‘আপনিই বলুন মার্ক্স’। নারীবাদী নামক একটা তকমা তাঁর গায়ে পরানো হয়েছিল বটে, তবে তাঁর সাহচর্যে আসা অজস্র তরুণ কবির কাছে আজও তিনি ‘মল্লিকাদি’। যিনি কি না রবিবারে তাঁর বাড়িতে আড্ডা মারতে গেলে দুপুরে না খাইয়ে ফেরত পাঠাতেন না। নিছক ‘কথামানবী’ ছিলেন না তিনি।

রঙ্গে ভরা

সেই কবে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’। আর এ বঙ্গের রাজধানী (একদা এ দেশেরও) কলকাতা তো হাস্যপরিহাসে এই উপমহাদেশ-খ্যাত তা কে না জানেন। করোনার ‘করাল কুম্ভীর’ (লেখক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলি) ছায়া সত্ত্বেও তাকে নিয়ে ঠাট্টার শেষ নেই। উদাহরণ? কবিরা নাকি সত্যদ্রষ্টা হন। তাই সেই কবেই স্বয়ং ‘তিনি’ নাকি লিখেছিলেন, ‘ও করোনা কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ’...। এই মহামারির মুখে যে সব বাংলা গান এড়িয়ে চলা উচিত, সে সব নিয়েও বিস্তর আলাপ-আলোচনা চলছে। তার মধ্যে কয়েকটি হল, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’, ‘আরও কাছাকাছি, আরও কাছে এসো’, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’...। তবে কি, গুনগুন গান তো আর এড়িয়ে চলা যায় না। ফলে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ ‘যা গাইতে পারেন’ বা গাওয়া যায়— এমন একটা তালিকাও পেশ করেছেন। ‘ও পারে থাকবে তুমি আমি রইব এ পারে’, ‘তারে বলে দিও সে যেন আসে না আমার দ্বারে’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়’...। অন্তিমে পৌঁছে এ বিষয়ে একটি শব্দই ব্যবহার করা যায়— অলমিতিবিস্তারেণ।

হৃদয় দিয়ে

‘আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য উপাদান’, বলছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী পদ্মশ্রী রঘু রাই, ‘শুধু হৃদয় দিয়ে আসলটুকু খুঁজে নিতে হবে।’ ক্যালকাটা স্কুল অব কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফির উদ্যোগে সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত হয়েছিল সংস্থার তৃতীয় বার্ষিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের আলোকচিত্রের সঙ্গেই প্রদর্শিত হয়েছিল ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় আজকের ভয়াবহতা নিয়ে রঘু রাই কন্যা অবনীর তোলা আলোকচিত্র। এই প্রদর্শনীর শেষ দিন, ১৫ মার্চ বিকেলে এখানেই ছিল একটি ফোরাম। এখানে ‘ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং ইন কনটেম্পোরারি স্ট্রিট ফটোগ্রাফি’ বিষয়ে বলেন রঘু রাই (সঙ্গের ছবি)। তাঁর সঙ্গে কথকতায় ছিলেন সংস্থার কর্ণধার শৌনক বন্দ্যোপাধ্যায়। রঘু রাই বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল কম্পিউটার আমাদের এই মস্তিষ্ক, আমাদের যত ক্রিয়েটিভ ভাবনা জমা থাকে এখানে। কিন্তু কেবলমাত্র ভাবনা থাকলেই হবে না, মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদয়েরও একটা ঘনিষ্ঠ যোগ থাকতে হবে। তবেই নতুন সৃষ্টি সম্ভব।’ এ দিন তিনি আলোকচিত্র বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন সহজ ভাবে।

সব স্তব্ধ

স্তব্ধ স্তব্ধ স্তব্ধ স্তব্ধ— স্তব্ধতার বাজনা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে বলা যায়। শেষ কবে এ মহানগরী এমন প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য, এমন থমকে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়েছে তা প্রবীণ নাগরিকরাও মনে করতে পারছেন না। যে কোনও রকমের প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ, বন্ধ যে কোনও রকমের মেলা বা বহু জনের একত্র হওয়া। শুটিং বন্ধ, রিহার্সাল বন্ধ। যাঁরা ‘জানালা ক্রেতা’ মানে উইন্ডো শপিং পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য শপিং মলও বন্ধ। এখন প্রশ্ন, তা হলে? তা হলে— লোকে তো কোথাও যাবে। কিন্তু কোথায় বা যাবে? সর্বত্রই তো ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র প্রথম লাইন ছিল (বঙ্গানুবাদে)— ইউরোপ এখন ভূত দেখছে কমিউনিজ়মের। এ শহরবাসী সেই ‘ক’তেই আক্রান্ত, তবে করোনা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘণ্টা চারেক যাও-বা বেশ কিছু যাত্রীকে পরিবহণে দণ্ডায়মান দেখা যায়, বাকি সময়টা হাতে গোনা কয়েক জনকে নিয়ে চলেছে। শুধু ওরা দিব্যি আছে। যেমন ময়দান ও তার প্রান্তরের মহীনের নয়, সেই সব ঘোড়াগুলি। যেমন রবীন্দ্র সরোবরের ৫০টি হাঁস— যারা নিজেদের পাখা ঝেড়ে, পিঠ খুঁটে অবিরাম জল বেয়ে চলেছে। যেমন একটু গাছপালা থাকলেই তার মধ্যে থাকা ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ আর বসন্তবৌরি, সেপাই বুলবুলি ও অন্যরা। খানিকটা স্বস্তি মুরগিকুলের। শুধু স্বস্তিই নয়, ভয়ানক বিস্মিত আলিপুর চিড়িয়াখানার আবাসিকরা— দু’পেয়ে জীবগুলো আসছে না, বাঁচা গেল। যত সময় এগোচ্ছে স্তব্ধতার বাজনা বেড়ে চলেছে। হুতোমের শহরের মানুষজন, যাঁরা সন্ধে হলেই আহিরিটোলার মোড়ে বা অন্য কোথাও গিজগিজ করতেন, তাঁরা ঘরমুখো। সন্ধে-রাত্রে গোটা পরিবার একটা টেবিল ঘিরে বা এক ছাদের নিচে— এমন তো বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ও অন্ধকার কলকাতা দেখেনি। শুধু থমকে থাকা আর আতঙ্ক এ শহরের পথে পথে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলেছে। শুধু মানুষের হৃদয়ের শব্দ আর ফেসবুক জেগে আছে। বাকি সব স্তব্ধ স্তব্ধ স্তব্ধ স্তব্ধ—

কবিতীর্থ

কবিতীর্থ পত্রিকা তার আবির্ভাব লগ্ন থেকেই অন্য স্বাদ বহন করে আনে বাঙালির কাছে। মননের অতি কাছের এর এক-একটি সংখ্যা, যা প্রায় সবই সংগ্রহযোগ্য। এ বারের সংখ্যাটিও তেমনই ব্যতিক্রমী— হারুকি মুরাকামি-কে নিয়ে। সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য যথারীতি লাভালাভের বাইরে গিয়ে মাঘ ১৪২৬-এর এই সংখ্যাটি প্রকাশ করে ফের প্রমাণ করলেন— সকলেই পত্রিকা নয়, কেউ কেউ পত্রিকা। সেই আন্তর্জাতিকতাতেই এসে দাঁড়িয়েছেন হারুকি মুরাকামি, দেশ তাঁর হতেই পারে জাপান কিন্তু লেখক তিনি গোটা পৃথিবীর। তাঁর ‘কাফকা অন দ্য শোর’ যিনি পড়েছেন তিনিই জানেন কী আশ্চর্য এক সৌভিক মায়ায় এ-রচনা আকীর্ণ। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বা ‘পিনবল, ১৯৭৩’ তো বিশ্বপরিচিত। সারা পৃথিবীতে লক্ষ কপির উপর বিক্রি ‘নরওয়েজিয়ান উড’-এর, আর ‘কাফকা অন দ্য শোর’ তো শোরগোল ফেলে-দেওয়া রচনা— যে জন্যে তিনি ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মানে। এখন শুধু নোবেলের জন্য প্রতীক্ষা। ২৮১ পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটিতে মুরাকামি-র উপর আলো ফেলা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে।

স্মরণাঞ্জলি

“সোমেন চন্দ বিশের কোঠায় পা-দিতে না-দিতে ঘাতকের ছোরার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন।… তিনি বেঁচে থাকলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটা বিরাট স্তম্ভ গড়ে তুলতে পারতেন।”— কিম্বার নার্সিং হোমের রোগশয্যায় মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে কথাগুলি লিখেছিলেন ‘কাকাবাবু’ মুজফ্ফর আহমদ। তাঁর এই ‘মুখবন্ধ’ সহযোগে স্বাধীনতা পরবর্তী দুই বাংলায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনাসংগ্রহ-এর প্রথম খণ্ড। দিলীপ মজুমদারের সুযোগ্য সম্পাদনায় প্রকাশিত দুই খণ্ডের সেই মূল্যবান গ্রন্থের পরিবর্ধিত সংস্করণ এক মলাটে পুনরায় প্রকাশ করলেন নবজাতক প্রকাশন। সযত্ন মুদ্রণ পারিপাট্যে দৃষ্টিশোভন গ্রন্থটিতে পাওয়া যাবে ‘দাঙ্গা’, ‘ইঁদুর’, ‘সংকেত’-সহ পঁচিশটি গল্প, ‘বন্যা’ উপন্যাস, ‘প্রস্তাবনা’ ও ‘বিপ্লব’ শিরোনামে দুটি নাটক, কবিতা, চিঠিপত্র। এ ছাড়া পাঁচটি পরিশিষ্টের মধ্যে ‘সোমেন চন্দের জীবনবৃত্ত’ ও ‘পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সোমেন সম্পর্কিত রচনা’ অংশ দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চা (নবজাতক প্রকাশন) গ্রন্থের লেখক দিলীপ মজুমদারের আন্তরিক শ্রমের নিদর্শন এই রচনাসংগ্রহ স্বল্পায়ু সোমেন চন্দের (১৯২০-১৯৪২) জন্মশতবর্ষে যথাযথ স্মরণাঞ্জলি।

প্রয়াণ

বিষহর, বাদ্যকর, যে দেশেতে রজনী নাই, অনন্ত হয়েছ, কুঠোবাবারা চইললেন … এই রকম অনেক বিচিত্র জীবনের বিচিত্র গল্পে সুব্রত মুখোপাধ্যায় নিজেকে চিনিয়েছিলেন গত শতকের সত্তর দশকের শেষে, আশির দশকের আরম্ভে। মেজাজে বিলুপ্তপ্রায় বনেদিয়ানায় ভরপুর, লেখায়ও সেই বনেদি ঘরানার ছায়ায় ঈষৎ আবৃত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম সাধক কবি রামপ্রসাদের হাবেলিশহর, হালিশহরে ১৯৫০-এর ৪ জুন। প্রথম উপন্যাস ‘পৌর্ণমাসী’র পটভূমিও সেই হাবেলিশহর-হালিশহর। প্রথম উপন্যাসেই সুব্রত নিজেকে মেলে ধরেছিলেন অপরূপ কথন ভঙ্গিতে। এর পর... রসিক, মধুকর, সন্ত্রাস... উপন্যাস লিখেছিলেন পর পর। ‘যে দেশেতে রজনী নাই’ গল্পে ছিল যে বীজ, পরবর্তী কালে লিখেছিলেন ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’— রামপ্রসাদকে নিয়ে বৃহৎ উপন্যাস। ‘রসিক’ ছিল পুরুলিয়ার নাচনি সম্প্রদায়ের আখ্যান। সুব্রতর গানের গলা ছিল মধুর, তাঁর ভরাট গলায় রামপ্রসাদী গান, তারাশঙ্করের গান শোনা ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও ছিল গভীর আগ্রহ। পুরনো রেকর্ডের সংগ্রহও ছিল কম না। হালিশহর ছেড়ে তিনি বারাকপুরনিবাসী হয়েছিলেন। সম্প্রতি উনিশ শতক হয়ে উঠেছিল তাঁর আখ্যানের বিষয়। এই গুণী লেখক পেয়েছিলেন সাহিত্য অকাদেমি এবং বঙ্কিম পুরস্কার। গত ১৭ মার্চ মাত্র ৬৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন।

বাজার বাড়ছে

বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতেই শহরবাসী খুশি। এই তাপমাত্রাই নাকি প্রাণঘাতী করোনার জীবনসংহারক। এর কোনও প্রমাণ যদিও পাওয়া যায়নি। কিন্তু খুব গোপনে সমুদ্রের জলস্তর যেমন বেড়ে উঠছে, তেমনই বাজারে জিনিসপত্রের দামের তাপও তেমনই বেড়ে উঠছে। ‘‘এই তো দেখুন না ব্যাঙ্গালোর থেকে সজনে ডাঁটা আর কাঁচা আম আসে, দিল্লি থেকে আসে লাল গাজর, সে সব আসা প্রায় বন্ধ। নাসিকের মাল ঢোকার তো কোনও কথাই নেই। গ্রামের মহিলারা যে আনাজ নিয়ে এই সাউথ ক্যালকাটায় ঢোকে তাতে কতটুকু কাজ হবে!’’ এটা প্রশ্ন এবং এ নিয়ে চিন্তিতও লেক মার্কেটের আনাজ ব্যবসায়ী মধুবাবু। জ্যোতি ও চন্দ্রমুখী আলু সপ্তাহের মাঝামাঝি ছিল ১৮ ও ২২ টাকা। এ বার এদের পারদ চড়বে। যেমন ৪৮ বা ৫০ টাকা কেজির চাল মিলবে আরও ৩ টাকা বেশি দিয়ে কেজিতে। ৪০-এর পেঁয়াজ— ভুলে যান। সংস্থার নামবিহীন অ্যালকোহল (৭৬%) যুক্ত হস্তপ্রক্ষালন তরল বাজারে পৌঁছেছে। মুদ্রিত মূল্য ২৫০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। মান্না দে-র গাওয়া গান ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’ মনে পড়ে যাবে টালিগঞ্জ থানার উল্টো দিকে মা সর্বমঙ্গলার মন্দিরের গায়ে অরুণবাবুর ভাতের হোটেলের কিয়স্কে গেলে। সকালে আনাজ কাটতে কাটতে বললেন, ‘‘জানি চার দিকে একটা থমথমে ভাব। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। তবে আমার সব কাস্টমারই বাঁধা। এ বিপদের দিনে আমি দাম বাড়াতে পারব না। দু’পয়সা লাভ কম করি ক্ষতি নেই।’’ গোটা শহরের অন্যান্য দিক যখন স্তব্ধ তখন এই বাজারই যা খোলা, আর না খুলেই বা উপায় কী? কিন্তু প্রশাসন যদি ‘অন্ধকার বাজার’-এর অন্ধকার বাজারিদের নজরদারি করে তবে সাধারণ মানুষ খানিকটা হলেও স্বস্তি পান। সুখ এখন অনেক দূরের কথা।

বেঁচে থাকবে

শেফিল্ড থেকে ঋতুপর্ণা পরাশর তাঁর দাদাকে জানিয়েছেন, ‘আমাদের এখানে লকডাউন অবস্থা, তোরা কেমন আছিস?’ বাইপাসের মেট্রোপলিটন সংলগ্ন নির্মাণ সংস্থা মা তারা এন্টারপ্রাইজ়ের কর্ণধার বিশ্বজিৎ দাসের কথায়, ‘‘যেখানে যত সাইটে কাজ চলছিল সব ওয়ার্কার পালিয়েছিল। পরে ধরে এনে মাস্ক দিয়ে স্যানিটাইজ়ার দিয়ে ডবল টাকা দিয়ে কাজ চালু রেখেছি। উপায় কী বলুন?’’ দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি নার্সিং হোম যার কর্ণধার নিজের নাম, সংস্থার নাম— দুটোই জানাতে চান না, তাঁর কথায়, ‘রোগী এলেই আর হচ্ছে না। আগে সিমটম জানতে চাইছে আমাদের স্টাফরা, তার পর—।’’ রঞ্জিত দাস একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কর্ণধার। তিনি বলছেন, ‘‘বহু ছেলেরই কাজের দরকার। কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে কেউ কাজ করার বদলে প্রাণ বাঁচানোটাই আসল বলে ধরেছে। ফলে বিজনেস তো ডাউন যাচ্ছে।’’ বেসরকারি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তাব্যক্তি দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘যাই হোক না কেন অফিস যেতেই হবে।’’ ‘‘আমি একটা নাটকে অভিনয় করি তার নাম অয়দিপাউস। সেখানে আমি সংলাপে বলি, আমি জানি না আমার শত্রু কে, কার সঙ্গে আমি লড়াই করছি। এই পরিস্থিতিও তাই। আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদের সন্তানসন্ততিরা বাঁচবে। এই সদর্থক মনোভাব নিয়েই আমি চলি’’, বলছিলেন দেবশঙ্কর হালদার। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সহাস্যে জানালেন, ‘‘আমার মেয়ে আর ছেলে দুই দিকে দুই পাহারাদার। এরা এখন থেকে আমাকে কোথাও যেতে দেবে না। তা হোক। হয়তো গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন, কিন্তু এর মধ্যেও মানুষ ও মানব বেঁচে থাকবে।’’

গল্পগাছা

গল্প যত বার বলা হয়, একটু-একটু করে বদলে যায়, যে হেতু মুখের ভাষার কোনও বাঁধাবাঁধি নেই, যখন যিনি বলেন তাঁর মনোভঙ্গি-ই কথিত গল্পটিকে একটা আকার দেয়। ‘‘প্রতিদিনের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গল্প বলা বা শোনার সময়টাও... এইটুকু বলা যেতে পারে সভ্যতার ইতিহাসে একটা ঐতিহ্য কখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় না।’’ লিখেছেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘হরপ্পা/ লিখন চিত্রণ’-এর (সম্পা: সৈকত মুখোপাধ্যায়) সাম্প্রতিক ‘গল্পগাছা’ সংখ্যাটির শুরুতেই। সম্পাদকের মতে, ‘‘মুখে-বলা এই গল্প আমাদের বিবর্তনের সাক্ষী, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের আলেখ্য... ’’। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনবদ্য কলমে মহাভারত-এর গল্পগাথা নিয়ে: ‘ধর্ম আছ তুমি কোথায়’, অবতল জীবনের সন্ধানী সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথের অভিজ্ঞতা, দেবাশিস বসুর ‘মনে-থাকা গল্পকথা’য় প্রাচীন বাঙালি পরিবারের ইতিহাস, সুনন্দা সিকদারের ময়মনসিংহের গল্প-বলার স্টাইল ও বিবর্তন, শ্যামলী দাসের কাঁথা-র কথা, ভবেশ দাসের বেতারে গল্পের দাদা-দিদি-দাদুরা... এমনই আরও মনকাড়া রচনা মিহির সেনগুপ্ত অশোককুমার কুণ্ডু দীপঙ্কর ঘোষ সত্যশ্রী উকিল কিশোর দাস দেবাশিস গুহনিয়োগী অমিতাভ সেনগুপ্ত ভাস্কর দাস সৌম্যদীপ ও স্বয়ং সম্পাদকের। দৃষ্টিনন্দন শিল্প-অলঙ্করণ ও সোমনাথ ঘোষের প্রচ্ছদে শোভিত গোটা সংখ্যাটি। স্বতন্ত্র ক্রোড়পত্রে: বাংলাদেশের লোককথায় ‘বোকা জামাই’। সঙ্গে পত্রিকার প্রচ্ছদ।

মোহিনী চৌধুরী

স্বাধীনতা কি প্রজাতন্ত্র দিবসে পতাকা তুলে গান হত ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। কেউ জানতাম না গানটার লেখক কে আর কেই বা সুর করেছেন। আজ শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জানা গেল গীতিকার মোহিনী চৌধুরী ও সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র দে। এমন অনেক অজানা কবিতার কথা জানা গেল সম্প্রতি বেহালা শরৎ সদনে দু’দিনের অনুষ্ঠানে। অপ্রকাশিত বহু কবিতা এখনও রয়ে গিয়েছে শুনে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কবীর সুমন আরও এক শিল্পী কল্যাণ সেনবরাটের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন, তাঁরা সুর দিয়ে নতুন প্রজন্মকে দিয়ে গাওয়াবেন। প্রস্তাব শুনে খুশি কন্যা মিতালি সেন ও পুত্রদ্বয় ভবিষ্যৎ ও দিগ্বিজয় চৌধুরী। ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার ডহরপাড়া গ্রামে ১৯২০-র ৫ সেপ্টেম্বর জন্ম মোহিনী চৌধুরীর। শৈশবে উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়া, মির্জাপুর হয়ে বেহালা ইউনিক পার্কে বাড়ি করা ১৯৪০-এ। সেই থেকে কবিতা লেখা ও সুর করা যেন পেয়ে বসেছিল। এমন অনেক কবিতা সিগারেটের প্যাকেটে লিখে ফেলে দিয়েছেন অজান্তেই, জানালেন মিতালি। কবির কবিতা প্রথম গান হয়ে প্রকাশ পেল কুসুম গোস্বামীর কণ্ঠে ‘রাজকুমারী ওলো নয়নপাতা খোলো’। এক সময় পুজোর আকাশে ঝড় তুলল ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানটি। কণ্ঠ দিলেন পড়শি সত্য চৌধুরী। লিখে গিয়েছেন আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, জেগে আছি কারাগারে, নাই অবসর বাজায়োনা বীণাখানি, ভেঙেছে হাল ছিঁড়েছে পাল, আজি কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী-র পাশাপাশি কী মিষ্টি দেখ মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল, কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল -র মতো গান। শতবর্ষ উদ্‌যাপন চলবে বছর জুড়ে। একটি স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হল।

প্রসঙ্গ শিল্প, সাহিত্য

ভারতীয় শিল্পীরা কেউ কখনও কি চিত্রায়িত করেছেন দান্তেকে?— এমন প্রশ্ন তুলে পূর্ণেন্দু পত্রী লিখছেন ‘‘উত্তর হবে হয়তো ‘না’-ই। তবে একজন ভারতীয় শিল্পীকেই জানি শুধু আমরা, যিনি জাপান থেকে ফেরার সময় স্টিমারে বসে ছবি এঁকেছিলেন দান্তের একটা প্রতিকৃতি। সে ভারতীয় শিল্পীর নাম, রবীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর বয়স ঊনসত্তর।’’ পূর্ণেন্দুর এই প্রসঙ্গ: শিল্প, সাহিত্য বইয়ের (প্রতিক্ষণ) প্রবন্ধটির নাম ‘রবীন্দ্রনাথের দান্তে’। ‘‘তাঁর সমগ্র সৃষ্টির আলোচনায় দান্তের কথা এসে যায় তবু বারবার।’’ মনে করেন পূর্ণেন্দু। তিনি নিজে শিল্পী বলেই এ-বইয়ে মার্ক স্যাগাল, কার্তিয়ে ব্রেসোঁ থেকে পরিতোষ সেন পর্যন্ত স্বচ্ছন্দ যাতায়াত তাঁর। লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের প্রকাশের ভিন্নতর শিল্পরূপ নিয়েও। অবশ্যসংগ্রহযোগ্য।

আত্মোপলব্ধি

গানের সুরেই আমার আত্মোপলব্ধি, এই বিশ্বাস অবলম্বন করেই পথ চলেন শিল্পী মহালক্ষ্মী আইয়ার। সমৃদ্ধ পরিবারে ওঁর বড় হয়ে ওঠা চেম্বুরে। পড়েছেন মুম্বইয়ে, এখান থেকেই স্নাতক। অন্তরে সুরের টান ছিল বলেই পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন সুরের জগতে। ওঁর মা কর্নাটক ঘরানার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী। ফলে বাড়িতে ছোট থেকে সঙ্গীতের পরিবেশ। তাঁরা তিন বোন ছোটবেলায় এক সঙ্গেই রেওয়াজ করতেন। ১৯৯৬ সালে ‘দশ’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাকের কাজ করেন, কিন্তু পরিচালকের আকস্মিক মৃত্যুতে সেটি সম্পূর্ণ হয়নি। পরে পরিচালকের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে এটি একটি অ্যালবাম হিসেবে প্রকাশ পায়। ওই একই সময়ে ‘এক আজনবি’-র জন্য গান গেয়েছিলেন তিনি। মূলত হিন্দি এবং তামিল গানের জন্য বিখ্যাত হলেও, তিনি তেলুগু, মরাঠি, কন্নড়, ওড়িয়া, গুজরাতি, অসমীয়া এবং বাংলাতেও গান গেয়েছেন। বলিউডের এ কালের খ্যাতকীর্তি সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, যেমন এ আর রহমান, শঙ্কর-এহসান-লয়, বিশাল-শেখর বা যতীন-ললিত প্রমুখ। ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি। ‘আঁধার’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আলফা সম্মান লাভ করেন। এ ছাড়া মহারাষ্ট্র কলা নিকেতন সম্মান-সহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি ঘুরে গেলেন এই শহরে। জ্যাজ, বিশ্ব লোকসঙ্গীত এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সুর মিলিয়ে বিশিষ্ট তালবাদ্য শিল্পী পণ্ডিত তন্ময় বসু নির্মাণ করেছেন এক বিশেষ ধারা ‘রিদম্যানিয়া’ শীর্ষকে। সঙ্গীতের এই বিবিধ ধারার এক যোগসূত্র গড়ে তুলেছেন তন্ময় বসু। আর এই নির্মাণে এ বারের সঙ্গী শিল্পী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন মহালক্ষ্মীকে। দক্ষিণ কলকাতা সংসদ-এর উদ্যোগে দেশপ্রিয় পার্ক সংসদের মাঠে অনুষ্ঠিত হল রিদম্যানিয়া-২-এর পরিবেশনা। তার আগে দুই শিল্পী গানের সঙ্গে কথকতায় ছিলেন টপক্যাট সিসিইউ-তে।

শহরে ফিরল রাধিকামোহনের বাদ্যযন্ত্র

‘পরম্পরা চলে ভক্তি, বিশ্বাস আর ভালোবাসায়’, প্রায়শই একথা বলতেন পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র। সকলে ওঁকে রাধুবাবু বলেই সম্মান করেন বেশি। এই কিংবদন্তি শিল্পীর জমিদারি ছিল রাজশাহিতে। এখানেই ওঁর দরবারে সে কালের গুণী শিল্পীদের সমাবেশে তৈরি হয়েছিল এক বিরাট পরম্পরা। ওঁর পাখোয়াজ গুরু ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য ভগবানচন্দ্র সেন। বিভিন্ন সময়ে ওঁর দরবারে জমা হয়েছিল ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের এক বিরাট সম্ভার। রাধুবাবু নিজেও সৃষ্টি করেছেন বেশ কিছু যন্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে মোহনবীণা, দিলবাহার এবং নবদীপা। রাধিকামোহনের ১৯১৮ সালের সুরবাহারটি প্রায় ৪০ বছর ধরে ছিল ফিলাডেলফিয়ার যন্ত্র ও সঙ্গীত বিষয়ক লেখিকা অ্যালিন মাইনারের সংগ্রহে। অন্য দিকে, এই পরম্পরার চর্চায় থাকা রাধুবাবুর গুরু মহম্মদ আমীর খাঁ সরোদিয়ার পিতা আবদুল্লা খাঁ-র সময়ে, ১৮৮৫ সালে তৈরি একটি সরোদ ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে সানফ্রান্সিসকো শহরে ছিল মার্কিন শিল্পী জোডি স্টেকারের কাছে। এঁরা দু’জনেই তাঁদের এই অমূল্য এবং ঐতিহাসিক যন্ত্র দু’টি সম্প্রতি তুলে দিলেন রাধুবাবুর পরম্পরার বর্তমান ধারক-বাহক সোমজিৎ দাশগুপ্তের হাতে, সঙ্গের ছবি। সোমজিৎবাবুর প্রয়াসে এই দু’টি যন্ত্র ফিরল কলকাতায়। যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী সোমজিৎ দাশগুপ্ত এই পরম্পরা বহন করে চলেছেন গত চার দশক ধরে। প্রায় দুইশতের বেশি যন্ত্রের এই পরম্পরায় রয়েছে ৩২ রকমের বাদ্যযন্ত্র। সোমজিৎবাবুর আন্তরিক উদ্যোগে বিদেশ থেকে আরও কিছু পরম্পরাগত বাদ্যযন্ত্র ফিরে আসছে এই কলকাতায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy