কলকাতার কিন্তু তখন দারুণ দুঃসময়, অথচ আমার বোধ বা উপলব্ধির জন্যে বোধ হয় ওর চেয়ে সুসময় আর আসেনি।” লিখেছিলেন মৃণাল সেন। যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষে মানুষের জীবন ও সত্তা যখন ধ্বস্ত, সেই দুঃসময়ে দেখা-পাওয়া নতুন মানবসত্য— তা যতই ভয়ঙ্কর, অপ্রিয় হোক— ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি একের পর এক ছবিতে। গতকাল ১৪ মে ছিল তাঁর জন্মদিন, সদ্য উদ্যাপিত সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন এবং তাঁর জন্মশতবর্ষের আবহ মনে করিয়ে দিচ্ছে, মৃণাল সেনের (১৯২৩-২০১৮) জন্মশতবর্ষও চলে এল বলে। রোগপীড়িত এই দুঃসময়ে তাঁর মতো জীবনশিল্পীর শিল্পবোধ প্রেরণা দেবে।
মৃণাল সেনের জীবন, দর্শন ও চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি ডিজিটাল সংগ্রহালয় তৈরির কাজ শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগেই, উত্তরপাড়ার ‘জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভ’-এর অরিন্দম সাহা সরদারের উদ্যোগে। মৃণাল সেনের প্রয়াণের পর, ২০১৯-এ তাঁর পুত্র কুণাল সেন জীবনস্মৃতি-কে দিয়েছিলেন মৃণাল সেনের সংগ্রহে থাকা ফিল্ম, শিল্প, রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে চারশোরও বেশি বই, পত্রিকা, একটি বুকশেলফও। আরও ছিল মৃণাল সেনের বিভিন্ন ছবির আড়াইশো অমূল্য শুটিং স্টিল, তাঁর ব্যবহৃত কলম, চশমা, পাইপ, পাজামা-পাঞ্জাবি, জহর কোট, টুপিও।
এখানেই শেষ নয়। ২০১২-১৪, পর পর তিন বছরে জীবনস্মৃতি-র তরফে নেওয়া পরিচালকের অডিয়ো ও ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার, নানা সময় ও মেজাজের আলোকচিত্রেও সমৃদ্ধ এই আর্কাইভ। ১৯৮৭ সালে মৃণাল সেনের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সোমেশ্বর ভৌমিক, প্রায় আড়াই ঘণ্টার সেই অডিয়ো-ইন্টারভিউটিও আছে আর্কাইভে। বিভিন্ন বই, খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকায় নানা সময়ে প্রকাশিত মৃণাল সেনের সাক্ষাৎকার, তাঁর চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে তাঁর নিজের ও অন্য লেখকদের লেখাও গুছিয়ে রাখা আছে এই সংগ্রহে। জোরকদমে চলছে টিভিতে এবং বহুবিধ ব্যক্তিগত উদ্যোগে নেওয়া মৃণাল সেনের অডিয়ো-ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার, ক্যামেরাবন্দি করা হচ্ছে তাঁর পরিচালিত ছবি ও নাটকের অভিনেতা ও কলাকুশলী, আত্মীয়-বন্ধুদের সাক্ষাৎকারও। মৃণাল সেনের লেখা বইয়ের প্রথম সংস্করণ, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, চিত্রনাট্য সংগ্রহ করা, উপযুক্ত নথিপত্র, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র-পুস্তিকা ইত্যাদির ডিজিটাল প্রতিলিপি, তথ্য-তালিকা ও পঞ্জি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে; উত্তরপাড়ায় জীবনস্মৃতি-র একটি ঘরকে ‘মৃণাল-মঞ্জুষা’ নামের মিউজ়িয়ামে সাজিয়ে তোলা, শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির কাজও।
শতবর্ষ-অভিমুখী জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভ প্রকাশ করেছে একটি বাংলা ক্যালেন্ডার, বিষয় ‘নিরানব্বইয়ে মৃণাল সেন, পঞ্চাশে কলকাতা ৭১’। এই ক্যালেন্ডারে থাকছে এ যাবৎ অপ্রকাশিত মৃণাল সেনের একটি সাদা-কালো আলোকচিত্র (ছবিতে) ও কলকাতা ৭১ চলচ্চিত্র-পুস্তিকার প্রচ্ছদের প্রতিলিপি— ছবিটির সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণে। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হল পদাতিক ছবির পোস্টারের প্রতিলিপিও। ক্যালেন্ডারটির উদ্বোধনে ছিলেন কুণাল সেন ও নিশা রুপারেল সেন, পোস্টারটি প্রকাশ করলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়।
সেবাপথ
জেলাশাসক নিজে পুকুরে নেমে পড়েছেন কচুরিপানা সাফ করতে! ফি-বছর ম্যালেরিয়া, কলেরায় বাংলায় মৃত্যুর হাহাকার, তা থেকে রক্ষায় এ ভাবেই এগিয়ে আসার ডাক দিয়েছিলেন আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১) (ছবিতে)। পরে শুরু করেন ব্রতচারী আন্দোলন, তার দার্শনিক স্বরূপ ফুটে উঠেছিল তাঁর লেখা বহু গানেও। লোক-দেখানো স্লোগান তাঁর কাছে ভণ্ডামি, দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন ‘জমিবন্দনা’র কাজে— ‘কোদাল হাতে খাটে যারা তারাই আসল ভদ্রলোক।’ স্বল্পায়ু জীবনে বাংলার লুপ্ত লোকসংস্কৃতির নানা অভিজ্ঞান পুনরুদ্ধারও তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি। লিখেছেন বই, প্রকাশ করেছেন পত্রিকা। গত ১০ মে জন্মদিন ছিল তাঁর। যে অতিমারি আজ ছেয়ে ফেলেছে বঙ্গভূমিকে, ব্রতচারীসুলভ সেবা ও চর্যা কি দেখাতে পারে না তা থেকে মুক্তির সদর্থক পথ?
কে জাগে
অতিমারির এক-একটি দিন যায়, রাত আসে, কে জাগে সেই রাতে? মানুষকে বাঁচানোর লড়াইয়ে রাখতে, কাজ করতে করতে কিংবা অজানা আশঙ্কাতেই ক্লান্ত, ত্রস্ত যাঁরা, তাঁদের শরীর ও মনের খবর রাখতে রাত জাগছে কলকাতার নাট্যদল ‘কসবা অর্ঘ্য’। ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে তাদের রাত জাগা— কথায়, গানে, সেতার-সরোদ-বাঁশিতে, পাঠে, অভিনয়ে। জরুরি খবর বলা হচ্ছে তারই মধ্যে, দেওয়া হচ্ছে বেড, অক্সিজেন, রক্ত, ওষুধ, দরকারি জিনিসের খোঁজ। কাজ চলছে তিনটে দল গড়ে, ফোনে খোঁজ নিয়ে, তালিকা বানিয়ে। রাত জেগে সঙ্গ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পীরাও। রাত সাড়ে ১১টা থেকে কসবা অর্ঘ্য-র ফেসবুক পেজে জীবনের এই কনসার্ট চলছে ভোর সাড়ে ৫টা অবধি। এ এক অন্য কোজাগরী পালন— সূর্যের ভোরের, জীবনের অপেক্ষায়।
নিভৃতচারী
কোনও শিল্পী জীবনের মধ্যপথ অতিক্রমের পর দুয়ার বন্ধ করে দিতে চান। শান্তিনিকেতনের শিল্পী পিনাকী বড়ুয়ার (১৯৫৪-২০২১) শিল্পজীবন তেমনই এক অসমাপ্ত আঁচড়ে আঁকা হয়ে রইল। সত্তরের দশকের কলাভবনের উজ্জ্বল ছাত্র, কিন্তু তাঁকে শুধু কলাভবনের শিল্পী হিসেবে দেখলে ভুল হবে। আজকের ছাপাই ছবির জগতে তিনি এক আলোকিত অধ্যায়— লিথোগ্রাফ, অ্যাকোয়াটিন্ট, ড্রয়িং, কাঠখোদাই, সব দিকেই সাড়া জাগানো কাজ। তাঁর মতো অনুভূতিশীল প্রিন্ট-মেকার পাওয়া যাবে না সহজে। অধিকাংশ কাজেই ছিল সাদা-কালোর মায়াভুবন। শিল্পী সোমনাথ হোরের কাছে শিল্পশিক্ষার পাঠ; শিক্ষকতা করেছেন স্কুলে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁর আপন কলাভবনে। কলকাতা-সহ দেশে-বিদেশে বহু প্রদর্শনী হয়েছে, করেছেন কর্মশালাও। গত ২৯ এপ্রিল চলে গেলেন নিভৃতচারী এই শিল্পী।
ডাক-উদ্যোগ
সত্যজিৎ রায়ের উপর প্রথম ডাকটিকিটটি ভারতীয় ডাকবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালের ১১ জানুয়ারি। উদ্বোধন হয়েছিল কলকাতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসব চলাকালীন নন্দন-এ—দু’টি ডাকটিকিটের একটি সেট, সঙ্গে ‘ফার্স্ট ডে কভার’। ২০০৯ সালের ২১ মার্চ ডাকবিভাগ সত্যজিৎ রায়ের উপর তিন টাকা দামের আর একটি ছোট ডাকটিকিট প্রকাশ করে। সেটি ছিল দশম ‘ডেফিনিটিভ সিরিজ়’-এর অন্তর্গত। এ বছর সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কোনও ডাকটিকিট এখনও না বেরোলেও, এখন সত্যজিৎ পত্রিকার (সম্পাদক: সোমনাথ রায়) উদ্যোগে ও চিফ পোস্ট মাস্টার জেনারেলের (পশ্চিমবঙ্গ সার্কল) অনুমোদনে কলকাতা জিপিও-র ডিরেক্টর কর্তৃক একটি ‘স্পেশাল কভার’ (ছবিতে তারই অংশ) প্রকাশিত হল গত ৩ মে। পরিকল্পক ডাকটিকিট বিশেষজ্ঞ দীপক দে।
নিলামঘর
উঁচু খিলানওয়ালা, পলস্তারা-খসা দেয়ালের বিরাট ঘরটায় ঢুকতেই বোঝা যায়, আগেকার কৌলীন্য এখন অতীত। রাসেল স্ট্রিটের নিলামঘর ‘দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ’ টিকে থাকার লড়াইটুকু করে চলেছে অতিমারির এ শহরে। নানা ডিজ়াইনের অফিস-আসবাব, তার মধ্যেই ঝিমোচ্ছে পুরনো আমলের আরামকেদারা। বাজারচলতি সস্তা জিনিসই নিলাম সামগ্রী— ডায়েরি, অ্যাশট্রে, টেলিফোন, পেয়ালা-পিরিচ, ছিন্নপত্র ম্যাগাজ়িন, গল্প-প্রবন্ধের বই। অন্য দিকে থমকে অতীত— ঝাড়বাতি, বর্মা টিকের আলমারি, চিনেমাটির প্লেট, আয়না বসানো ড্রেসিং টেবিল, পোর্সেলিনের পুতুল, পাথরের মূর্তি (নীচের ছবিতে)। ধুলো ঝাড়া হয় ‘পিরিয়ড পিস’-এর, ‘অ্যান্টিক’ মেলে না আর। এখন ছবির শুটিংয়ে ভাড়া খাটে জিনিস, নিলামঘরটাও। আর শহরের কোনও পুরনো বাড়ি ভাঙা পড়লে খবর আসে দোকানে। ছবি: তথাগত সিকদার
যুদ্ধের নাচ
নাচের মাধ্যমে মনের কথা প্রকাশ করেন শিল্পী। আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস চলে গেল ২৯ এপ্রিল, অতিমারিতে কোথায় আর উদ্যাপন! শিল্প তবু মাথা নোয়ায় না। আন্তর্জালে অন্য রকম ভাবে দিনটি উদ্যাপন করল ‘সৃজক কনটেম্পরারি আর্ট সেন্টার’। এ আর রহমানের উদ্দীপক সুরতালছন্দে কলাপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকেরা নিজেদের ঘর, ছাদ, বাগান থেকেই তুলে ধরলেন এ যুদ্ধের সেরা আয়ুধ, মুখচ্ছদ। কোভিড-বিধি মানার বার্তায়, হার না মানার আত্মবিশ্বাসে অসুখক্লিষ্ট, বেদনাদীর্ণ মনের শুশ্রূষা। গৌতম ও রূপা উপাধ্যায়ের ভাবনা, রূপায়ণ ও নৃত্য পরিচালনায় ‘হোপ’ নামক অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে সৃজক-এর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।
দিবসাভিধান
বাংলা পঞ্জিকাগুলোয় তারিখের পাতায় এত জটিল তথ্য থাকে, সাধারণ মানুষের বোঝা মুশকিল। সেই জটিলতা কিছুটা হলেও দূর করার লক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে দিবসাভিধান (সঙ্কলন: পার্থসারথি রায়)। ‘ধ্যানবিন্দু’ প্রকাশিত এই বইয়ে সহজে বুঝিয়ে দেওয়া আছে বাংলা মতে তারিখ, তিথি, ত্র্যহস্পর্শ, মলমাস ইত্যাদির ধারণা। আছে বিভিন্ন একাদশী, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার নাম, আর সবচেয়ে যা কাজের— প্রতিটি বাংলা মাস ধরে ধরে বিশেষ দিনগুলির উদ্যাপন-তথ্য, কৃষ্ণা ও শুক্লা তিথি অনুযায়ী পালনীয় দিনগুলির পঞ্জি, বিখ্যাত মানুষদের জন্ম ও প্রয়াণদিনের সন্ধান। একটি বাংলা মাস আসলে দু’টি ইংরেজি মাসের দুই অর্ধ জুড়ে বিস্তৃত, সেই দুই ইংরেজি মাসের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যাপন-দিনগুলির উল্লেখও আছে এখানে। বাংলা মাসের কোন তারিখ বা তিথিতে বাংলার কোন জেলায় কোন অঞ্চলে বা গ্রামে কী উৎসব, পূজা, ব্রত পালিত হয়, সযত্নে দেওয়া আছে সেই তথ্যও— ভ্রমণপিপাসুরা পাবেন চারশোরও বেশি মেলার হদিস।
শুভদিনে
অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই এ বার পেরিয়ে গেল ‘অক্ষয় তৃতীয়া’। শুভ কাজের সূচনা হয় এই দিনে। বহু ব্যবসায়ী হালখাতা করেন। মিষ্টি, ক্যালেন্ডারে গ্রাহক আপ্যায়ন হয়তো এ বার হয়নি, তবে লক্ষ্মী-গণেশের পুজোয় মিশেছে দুর্বিপাক পেরিয়ে যাওয়ার প্রার্থনা। অক্ষয় তৃতীয়ার গায়ে গায়েই ছিল ইদ-উল-ফিতর। খুশির ইদ, কিন্তু উদ্যাপনে রাশ। রেড রোডে নয়, ঘরেই নমাজ পড়েছেন মানুষ, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের কামনায়। প্রার্থনার সুরেই মিলে গেছে শুভদিন, শুভক্ষণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy