মেট্রো স্টেশনের কাছে চার ব্যক্তির হাত থেকে এক মহিলাকে বাঁচিয়েছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘দহন’-এর নায়িকা ঝিনুক। কোনও অস্ত্র নয়, ভরসা ছিল স্রেফ একটি ব্যাগ।
সেই উপন্যাসকে ঘিরে তৈরি চলচ্চিত্র সাড়া ফেলেছিল জনমানসে। কিন্তু ওইটুকুই। রোগ সারেনি। বদল ঘটেনি অসুস্থ মানসিকতার। ঝিনুকের মতো কেউ কেউ কখনও কখনও সাহস করে ঘুরে দাঁড়ান। সাহায্য করেন মানুষকে। কিন্তু ইদানীং সামলাতে হয় একাই। তাঁদের সঙ্গত দিচ্ছে একটি করে বড়সড় ব্যাগ। এ শহরের বাস, মেট্রো, ট্রেন কিংবা অটোতে সেই ছবির দেখা মেলে যত্রতত্র। সে কথা স্বীকার করেন বহু মহিলাও।
শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলাগামী একটি বাসের অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিড় ছিল কিছুটা কম। বাসটিতে দু’দিকের আসনের মাঝে পরিসর বেশি নয়। তবুও এক বয়স্ক ব্যক্তি এক মহিলার গায়ে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অস্বস্তি হলেও প্রথমে কিছু বলেননি ওই মহিলা। কিন্তু কিছু পরে মহিলা ধৈর্য হারান। মৃদু স্বরেই পাশের ব্যক্তিকে সরে দাঁড়াতে বলেন। সেই বয়স্ক ব্যক্তি সরেও যান। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরে ফের একই ঘটনা।
মহিলার সামনে বসা আসনের তরুণী ঘটনাটি লক্ষ্য করছিলেন। ইশারায় ওই মহিলাকে তাঁর আসনে বসতে বলে নিজে দাঁড়িয়ে পড়েন সেখানে। ওই ব্যক্তি অবশ্য সরে দাঁড়ালেন না। তরুণীও নিশ্চুপ। মিনিট দুয়েক পরেই বয়স্ক ব্যক্তি কার্যত চিৎকার করে উঠে বললেন, ‘‘আরে করছেন কী, ধাক্কা মারছেন কেন?’’ তরুণী ততই শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আপনার খুব ব্যথা লেগেছে? দুক্ষিত!’’ বয়স্ক ব্যক্তি কোনও কথা না বলে এ বার অনেকটা সরে দাঁড়ালেন। এ বারে তরুণী মুচকি হেসে সেই মহিলাকে বললেন, ‘‘পিঠের ব্যাগটা খুব দুষ্টু। বদমায়েশি সহ্য করে না।’’
ঘটনাটি চোখ এড়ায়নি বাকি যাত্রীদের। প্রথমে বয়স্ক ব্যক্তিকে তরুণীর ধাক্কা মারা নিয়ে চলল তর্ক-বিতর্ক। কেউ বললেন, গায়ে লাগলেই যদি অসুবিধা হয়, তবে ট্যাক্সি চড়ে যান। কারও কথায়, ভিড়ে গায়ে গা লাগতেই পারে, বিষয়টিকে অযথা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে অসম্মান করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বললেন, ‘‘আরে মশাই ছাড়ুন, এক দল লোকের স্বভাবটাই ও রকম। মেয়েটি ঠিক করেছে।’’
পরে অবশ্য আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এল ব্যাগ। বলা ভাল ব্যাগের মুণ্ডপাত শুরু হল। পুরুষ যাত্রীদের আলোচনায় সমান ভাবে অংশ নিলেন মহিলা যাত্রীদের একাংশও। তরুণী অবশ্য কারও কথাতেই আমল দিলেন না। শুধু তরুণী সেই মহিলাকে বললেন, ‘‘ঝগড়া করতেই পারতাম। কিন্তু ব্যাগ থাকতে মুখে কেন!’’
ঘটনাটি একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। কিশোরী থেকে তরুণী কিংবা প্রৌঢ়া— প্রতি দিন পথঘাটে এমন অনেক অভব্যতার মুখে পড়তে হয় মহিলাদের। যেমন এক কলেজ ছাত্রী রঞ্জনা ঘোষের কথায়, ‘‘অটোয় সামনে বসলে অনেক সময়েই চালকেরা অসুবিধার কারণ হয়ে ওঠেন। তখন ওই ব্যাগই সম্বল।’’ যদিও বাস-মেট্রোয় নিত্য যাতায়াত করা অনেকের মতেই, ওই ধরনের বড় ব্যাগ সমস্যা বাড়ায়। অফিসটাইমের ভিড়ে বড় ব্যাগ নিয়ে উঠলে রীতিমতো জায়গার সমস্যা হয়। কিন্তু নিত্যযাত্রী মহিলাদের বেশির ভাগেরই বক্তব্য, ওই ভিড়ের সময়ে বড় ব্যাগ আরও বেশি কাজে লাগে। অনির্বাণ সেন নামে এক কলেজপড়ুয়া বলেন, ‘‘ভিড় বাসে অভব্য আচরণ সামাল দিতে অনেক সময়ে সত্যিই আত্মরক্ষার কাজে লাগে। কিন্তু ব্যাগ কোনও সমাধান হতে পারে না। একাংশের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।’’
সেই পরিবর্তন আদৌ আসবে কি না, তা সময় বলবে। তবে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আকার-আয়তনে বেড়েই চলেছে ব্যাগ। এক ব্যাগ প্রস্তুতকারক সংস্থার মালিক হিমাংশু বসাক যেমন বললেন, ‘‘আত্মরক্ষার্থে ব্যাগ কাজে লাগছে, এমনটা ভাবিনি। তবে বাজারের চাহিদা মেনেই এখন বেশি বড় আকারের ব্যাগই তৈরি হচ্ছে। আগে কাঁধের এক পাশে ব্যাগ নেওয়ার প্রবণতাই বেশি ছিল। এখন পিঠে বা সামনে থেকে দু’কাঁধে ব্যাগ নেওয়ার চল বেড়েছে।’’
রক্ষাকবচ: অটোর সামনের সিট কিংবা ভিড়ে ঠাসা স্টেশন ও বাস, সর্বত্রই ভরসা বড় পিঠ-ব্যাগ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy