যন্ত্রণা: দু’নম্বর ওয়ার্ডের সাউথ সিঁথি রোডের ফুলবাগানে। নিজস্ব চিত্র।
সিঁথি থেকে কুমোরটুলি। কলকাতার প্রাচীন এই জনপদ এমনিতেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার উপরে বিগত বছরগুলিতে এলাকার মূল সমস্যা, যেমন রাস্তাঘাটের সংস্কার, নিকাশির উন্নয়ন এবং পরিচ্ছন্নতায় প্রশাসনের নজর পর্যাপ্ত ছিল না বলে অভিযোগ। ফলে
উন্নয়ন কম এবং অনুন্নয়ন বেশির গোলকধাঁধায় বিস্তীর্ণ এলাকা যেন ‘সমস্যার শপিং মল’।
কলকাতা পুরসভার এক নম্বর বরো। সিঁথি থেকে বেলগাছিয়া ও কাশীপুর থেকে কুমোরটুলি পর্যন্ত বিস্তৃত ১-৯ নম্বর ওয়ার্ডের এলাকা। সাবেক কলকাতার এই অংশে বিত্তবান, মধ্যবিত্ত, বস্তিবাসী, ফুটপাতবাসী থেকে বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের সহাবস্থান। সমস্যার চরিত্রও ভিন্ন। যার কয়েকটি হল, চিৎপুর রেল ইয়ার্ড ঘিরে ধুলোর দূষণ, দখলদারি, গঙ্গাপাড়ের দুরবস্থা, বস্তির সমস্যা। তবে মূল সমস্যা, বেহাল নিকাশির কারণে জল জমা, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, আবর্জনা সাফাইয়ের দুর্বিষহ ছবি। গত দু’বছরে উপরি পাওনা, নির্মীয়মাণ টালা সেতুর কারণে এখানে ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’।
নতুন টালা সেতু কবে সম্পূর্ণ হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন সকলের। অভিযোগ, নির্মীয়মাণ সেতুর যাবতীয় সামগ্রী টালা ঝিল পার্কের পাশের মাঠে রাখা হয়েছে। মাঠের চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে, তাঁবু খাটিয়ে থাকছেন কর্মীরাও। ফলে কলকাতার সবুজ ফুসফুস ধূসর হচ্ছে। যা দেখে আক্ষেপ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর তরুণ সাহার আশ্বাস, ‘‘আগামী এপ্রিলেই সেতুর কাজ শেষ হবে। নির্মাণকারী সংস্থা সেপ্টেম্বরের মধ্যে মাঠ আগের থেকেও ভাল অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে বলেছে।’’
এ তো গেল উন্নয়নের চাদর গায়ে অনুন্নয়নের চিত্র। কিন্তু যেটা পুরসভার হাতে ছিল, সেই রাস্তা বা নিকাশির সংস্কার কতটুকু হয়েছে এলাকায়? স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিটি রোডের দু’ধারেরই অবস্থা সন্তোষজনক নয়। যত্রতত্র খোঁড়া রাস্তা, মাটি স্তূপ করে ঢাকা সেই গর্ত, এবড়োখেবড়ো পথে হোঁচট, পুজোর মুখে তাপ্পি, সপ্তাহ না ঘুরতেই পথের চামড়া উঠে আসা— এই নিয়েই চলে গিয়েছে শেষ না হওয়া পথ।
তার সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে পুরনো কলকাতার সাক্ষী খোলা নর্দমা। দু’নম্বর ওয়ার্ডের সাউথ সিঁথি রোডের ফুলবাগানে এক কিলোমিটার লম্বা এই খোলা নর্দমা বাসিন্দাদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ। গত বছর এই এলাকার একাধিক মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অথচ, কেইআইআইপি-র ভূগর্ভস্থ নিকাশি প্রকল্পের কাজ ওয়ার্ডে হয়েছে বছর দশেক আগেই। স্থানীয় বাসিন্দা বিমান পালের অভিযোগ, ‘‘খোলা নর্দমার জন্য মশার অত্যাচারে টেকা যায় না। নর্দমা লাগোয়া জঞ্জালের কন্টেনার উপচে না পড়লে পরিষ্কার হয় না।’’ সব প্রশ্নের উত্তরেই অবশ্য ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর পুষ্পালি সিংহের আশ্বাস, ‘‘পুরসভার নিকাশি দফতরের সঙ্গে কথা বলেছি। নতুন বোর্ড এলেই খোলা নর্দমা ঢাকা হবে।’’
ভাঙা রাস্তার আরও এক অজুহাত, পানীয় জলের অপচয় রোধে ‘ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পের কর্মকাণ্ড। তিন বছর আগে ১-৬ নম্বর ওয়ার্ডে এর সমীক্ষা শুরু হয়। বাড়ি বাড়ি জলের মিটার বসাতে রাস্তা খুঁড়লেও তা মেরামত করা হয়নি বলে অভিযোগ। এক নম্বর বরোর কোঅর্ডিনেটর তরুণ সাহার অবশ্য দাবি, ‘‘ভবিষ্যতের স্বার্থে বর্তমানের সমস্যাকে মানিয়ে নিতেই হবে।’’
কেমন আছেন বরোর বস্তিগুলির কয়েক লক্ষ ভোটার? শাসক দলের পুর প্রতিনিধিদের দাবি, বস্তিতে পানীয় জল, শৌচালয়, বিদ্যুৎ ও আবর্জনা সাফাই পরিষেবা পর্যাপ্ত মেলে। সাত নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর বাপি ঘোষ জানাচ্ছেন, বস্তির শৌচালয়ে কমোড বসানোর ভাবনা রয়েছে। আট নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর পার্থ মিত্রের দাবি, ‘‘ওয়ার্ডের আটটি বস্তিতেই পর্যাপ্ত পানীয় জল যাচ্ছে।’’ ন’নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর মিতালি সাহা জানান, বস্তিতে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। দমকলের জন্য এলাকায় জলের স্টেশন তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। ছ’নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর সুমন সিংহ আবার জানাচ্ছেন, তাঁর ওয়ার্ডে শতকরা আশি ভাগ বস্তি। সেখানে সব পরিষেবাই মিলছে।
বস্তি এলাকাগুলির বাস্তব ছবিটা এ রকম। স্বল্প পরিসরে ঘিঞ্জি বাড়ি, মানুষ আর দাহ্যের সহাবস্থান, বিদ্যুতের তারের জট, যত্রতত্র জঞ্জাল। তিন নম্বর ওয়ার্ডে কলকাতার অন্যতম বড় বেলগাছিয়া বস্তির রাস্তার বেহাল দশা নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। যা শুনে ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর তথা সাংসদ শান্তনু সেন বললেন, ‘‘জলের লাইনের কাজের জন্য ওই অবস্থা। ভোটের আগেই ঠিক হয়ে যাবে।’’
দাহ্য বস্তুতে ঠাসা, ঘিঞ্জি এই বরো এলাকায় সাম্প্রতিক কালের বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে বাগবাজারের হাজার বস্তিতে। ভস্মীভূত ওই বস্তি নিয়ে প্রশাসনের উপরে ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের। ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে স্থায়ী ঘর তৈরির কাজে হাত দিয়েছে প্রশাসন।
আর পরিচ্ছন্নতা? ৯টি ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটরদের দাবি, আবর্জনা সাফাই সর্বত্রই নিয়মিত হয়। ৫, ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরলে বোঝা যায় সেই দাবিতে জোর আছে। কিন্তু ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতার অভাব পদে পদে নজরে আসে। গিরিশ মঞ্চ থেকে গঙ্গার ঘাট, বনমালী সরকার স্ট্রিট, কাশীপুর রোড, বিবিবাজার, বিটি রোড, চিড়িয়ামোড় থেকে দমদম স্টেশনের দু’পাশ, অলিগলিতে অপরিছন্নতার ছবি স্পষ্ট।
বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘উন্নয়ন হচ্ছে ফেস্টুনে। হাতেকলমে দেখা যাচ্ছে কোথায়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy