রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রয়াত মহাসচিব কোফি আন্নান এক সময়ে বলেছিলেন—‘‘পরিস্রুত পানীয় জলের অধিকার হল মৌলিক অধিকার।’’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘জলের অধিকার’ সংক্রান্ত প্রকাশনায় আন্নানের ওই বক্তব্যের পাশাপাশি ঘানার কিশোরী নাপোগা গুরিগোর কথাও বলা হয়েছিল। পরিবারের জলের প্রয়োজন মেটাতে নাপোগা প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় জল-অভিযানে বেরিয়ে পড়ে। সে স্কুলে যায় না। সে নিজের বয়স জানে না। নাপোগা জানে না, ‘জলের অধিকার’ কাকে বলে। তবে সে জানে, জলের স্বাদ কেমন! সেই স্বাদ সে চেটেপুটে নেয়। এমনকি, সেই জলের মধ্যে কাদা মিশে থাকলেও।
নাপোগা আসলে বয়স-স্থান-নির্বিশেষে সেই সব মানুষের প্রতিনিধি, যাঁদের জীবনের সিংহভাগই চলে যায় জলের সংস্থানে। এই উদাহরণ মোটেও কলকাতার ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ, সামগ্রিক ভাবে কলকাতা জল-সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু জল-সমৃদ্ধ হলেই কি অকারণে জল অপচয়ের অধিকার জন্মে যায়? না কি তা ‘আমাদের কখনও এই সঙ্কট হবে না’, এই ছদ্ম আত্মবিশ্বাসের কারণ হয়ে ওঠে? বরং জলশক্তিতে ‘বলীয়ান’ বলেই কি দায়িত্ব বেড়ে যায় না? যারা জল-সমস্যায় ভুগছে, তাদের সমস্যা নিরসনের?—প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। কারণ শহরের একাংশে এখনও পরিস্রুত পানীয় জলের ঘাটতি রয়েছে। কলকাতার বিদায়ী পুর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের কথায়, ‘‘যাদবপুর, টালিগঞ্জে পানীয় জল সরবরাহের জন্য এখনও গভীর নলকূপের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে।’’
সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে কলকাতায় নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল দৈনিক ১২১.৫ মিলিয়ন লিটার। ১৯৯৮ সালে তা বেড়ে হয় দৈনিক ২০৯.৭ মিলিয়ন লিটার। এই ধারা ২০০৬ পর্যন্ত বজায় ছিল।
আর সেই উত্তোলনের ফলে ১৯৫৮-২০০৩, এই ৪৫ বছরে শহরের জলস্তর ৭-১১ মিটার নেমে গিয়েছে। যে ক্ষত এখনও মেটেনি বলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, ভূগর্ভস্থ জলস্তর রিচার্জের নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে না। গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’ (সিজিডব্লিউবি)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতায় এলাকাভেদে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০-২০ মিটার নীচে জলস্তর পাওয়া যাচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধিকর্তা পঙ্কজকুমার রায় বলছেন, ‘‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন, জল রিচার্জের নীতি বাস্তবায়নের অভাবেই ক্রমশ জলস্তর নামছে। কমছে মাথাপিছু জল বরাদ্দের পরিমাণও।’’
যেমন সিজিডব্লিউবি-র সমীক্ষা জানাচ্ছে, অতিরিক্ত জল উত্তোলনের কারণে দেশের ৬৮৮১টি ইউনিটের মধ্যে (ব্লক/তালুক/মণ্ডল) ১৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১১৮৬টি ইউনিটই অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে গিয়েছে (ওভার এক্সপ্লয়েটেড)। পটনা, চণ্ডীগড়, দিল্লি, পুণে, ইনদওর, নাসিক-সহ দেশের ১৮.৭ শতাংশ ‘আর্বান লোকাল বডি’তেই (ইউএলবি) জলসঙ্কটের কথা সরকারি রিপোর্টে উঠে এসেছে।
নদী-বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার জানাচ্ছেন, যত জল মাটির নীচ থেকে তোলা হচ্ছে, সেই পরিমাণ জল ভূগর্ভে ঢুকছে না। ফলে ক্রমেই কমে আসছে পৃথিবীর পেটের জমানো অংশের জল, ভূবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাকুইফার’। তাঁর কথায়, ‘‘এই অ্যাকুইফারগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভূগর্ভ থেকে যত পরিমাণ জল তোলা হবে, ততই তার প্রভাব পড়বে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। যে কারণে নদী-খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে।’’ পরিবেশবিজ্ঞানী তথা ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তপন সাহা আবার বলছেন,
‘‘পরিকল্পনা করে শহরে এলাকাভিত্তিক জল রিচার্জের জন্য যে পরিকাঠামো গড়ে তোলার দরকার ছিল, সেটাই হয়নি। এমনকি, এ সম্পর্কে কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি। যেটুকু ধারণা রয়েছে, তা-ও ভাসা-ভাসা।’’
তাই জলস্তর নেমে যাওয়া ঠেকাতে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি নির্মোহ ভাবে বাদ দিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। ১৯৮৭ সালে রাজ্য সেচ দফতরের এক
বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট দেখিয়েছিল, কী ভাবে রাজ্যের ভূপৃষ্ঠ জলসম্পদের ১৩.২৯ মিলিয়ন হেক্টর মিটারের মধ্যে ৫.৩১ মিলিয়ন হেক্টর মিটার ব্যবহারযোগ্য। আর ভূগর্ভস্থ ১.৪৬ মিলিয়ন হেক্টর মিটারের পুরোটাই ব্যবহারযোগ্য। বর্তমানে জনসংখ্যা, রাজ্যের ভৌগোলিক চরিত্র-সহ সব কিছু পাল্টেছে। জনগণনার তথ্য বলছে, ১৯৮১ সালে কলকাতায় যেখানে জনসংখ্যা ছিল ৪১,২৬,৮৪৬, সেখানে ২০১১ সালে তা হয়েছে ৪৪,৯৬,৬৯৪। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। ফলে, এই পরিস্থিতিতে পানীয় জল সরবরাহ ও তার ব্যবহারে পুনর্মূল্যায়নের
প্রয়োজন রয়েছে।
পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা বুঝে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতা পুরসভা নির্দেশিকা জারি করে বলেছিল, জলস্তরের উপর ভিত্তি করে শহরের মানচিত্রকে ‘লাল’, ‘কমলা’ এবং ‘সবুজ’— এই তিনটি রঙে ভাগ করা হবে। ‘লাল’ চিহ্নিত এলাকার অর্থ, বেহিসেবি জল উত্তোলনের ফলে সেখানকার জলস্তর বিপজ্জনক ভাবে নেমেছে। ‘কমলা’-র অর্থ, জলস্তর নেমেছে মাঝারি মাত্রায়। আর ‘সবুজ’-এর অর্থ, সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূগর্ভস্থ জলে এখনও হাত পড়েনি। ঠিক হয়েছিল, একটি সার্বিক জলনীতিও তৈরি করা হবে।
সেই জলনীতি তৈরি হয়েছে কি? ফিরহাদ জানাচ্ছেন, হয়নি। কেন? বিদায়ী পুর প্রশাসকের উত্তর, ‘‘ওই কাজে সহায়তার জন্য বিশেষজ্ঞ সংস্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি।’’ তবে তিনি জানিয়েছেন, জলসঙ্কট মেটাতে ‘জয় হিন্দ’ জল প্রকল্পে দৈনিক আরও ২০ মিলিয়ন গ্যালন ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাবের পাশাপাশি একাধিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
তবে সে সবই ভবিষ্যতের কথা। স্রোতস্বিনী গঙ্গার দৌলতে ‘ভাগ্যবান’ কলকাতায় নাপোগা গুরিগো-রা না থাকলেও শহরে ক্রমাগত জলস্তরের পতন আটকাতে অনেকেই মনে করছেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিস্রুত জল বিনামূল্যে দিয়ে, জল অপচয়ের জন্য এখনই জলকর ধার্য করা দরকার। কিন্তু, মুখ্য হয়ে ওঠা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মধ্যে বেহিসেবি জল-খরচ রোধে জলকরের প্রসঙ্গ শুনছে কে?
বরং এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে উত্তর একটাই।— ‘চুপ, নির্বাচন আসছে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy