বিদেশি র্যাবাইয়ের উপস্থিতিতে প্রাক্-সাবাথ প্রার্থনাসভা। ব্রেবোর্ন রোডের মাগেন ডেভিড সিনাগগে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
১৪০ বছরের পুরনো মাগেন ডেভিড সিনাগগের রাজকীয় স্থাপত্যের সামনে দাঁড়ালে এখনও কানে আসে পাশেই পর্তুগিজ গির্জার ঘণ্টাধ্বনি। কিংবা ভেসে আসে নাখোদা মসজিদের আজান। সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পর পর ইহুদিদের নববর্ষ এবং তাদের সুক্কোট উৎসবের সময়ে এই সিনাগগে দাঁড়িয়ে এক কালে অনেকেই দুগ্গাপুজোর ঢাকের বাদ্যি শুনে পুলকিত হয়েছেন। তা লেখা আছে এ শহরের ইহুদিদের নানা স্মৃতিকথায়।
এ সব শব্দই আজও সজীব কলকাতার আকাশে-বাতাসে। শুধু ইহুদি প্রার্থনা সভায় ভাবগম্ভীর হিব্রু মন্ত্রধ্বনি প্রায় মুছে গিয়েছে। কলকাতার বহুত্ব চর্চার অন্যতম গয়না, সেই ঐতিহ্যধারা ফের সজীব করতে তৎপর এই শহরের ইহুদিদের একাংশ। তাই প্রতি মাসে ভারতের অন্য প্রান্ত বা বিদেশ থেকে ইহুদি পুরোহিত বা র্যাবাই আনিয়ে নতুন করে ওই অনুষ্ঠান তাঁরা চালু করছেন।
কলকাতার এক সময়ের বর্ধিষ্ণু অংশ সেই ইহুদিরা এখন জনা পনেরো বুড়োবুড়ি। দিন কয়েক আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁদের কয়েক জন ব্রেবোর্ন রোডের মুখে মাগেন ডেভিড সিনাগগে জড়ো হয়েছিলেন। শহরে এসেছেন দুই র্যাবাই, ইজরায়েলের ইশাই ডিয়েক এবং লন্ডনের জোনাথন গোল্ডস্মিথ। গুটিকয়েক ইহুদিকে নিয়ে প্রার্থনাসভা পরিচালনা করেন তাঁরা। ইহুদি বিধান মতে অবশ্য যথাযথ প্রার্থনাসভায় দশ জন পুরুষ থাকা আবশ্যক। কলকাতার ইহুদিদের মধ্যে এমন দশ জন খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবু উপস্থিত কয়েক জনের আন্তরিক আবেগ সব ঘাটতি পুষিয়ে দিল।
পেশায় শিক্ষিকা, দেশপ্রিয় পার্কের বাসিন্দা মিতানা আলেকজ়ান্ডার বললেন, “আমাদের ছোটবেলায় সিনাগগে ভিড় উপচে পড়ত। এখন ইহুদিদের কেউ মারা গেলেও সচরাচর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে র্যাবাই থাকেন না। অনেক দিন বাদে সিনাগগের সার্ভিসে খুব ভাল লাগছে।” প্রার্থনার পরে সিনাগগ প্রাঙ্গণেই বিধিমাফিক এক সঙ্গে সকলে খেতে বসলেন। ইহুদি বিধান মেনে তৈরি নিউ মার্কেটের নাহুমের খাল্লা ব্রেড এবং চিজ় সামোসা খাওয়া হল।
ব্রেবোর্ন রোডের ও পাশে পোলক স্ট্রিটে আরও একটি চোখ জুড়োন স্থাপত্য ১৬৬ বছরের বেথ এল সিনাগগেও শীঘ্রই এমন প্রার্থনাসভা আয়োজন করা হবে বলে জানাচ্ছেন ইহুদি সমাজের মাথারা। কলকাতার প্রথম ইহুদি শালোম কোহেনের উত্তরপুরুষ ডেভিড অ্যাশকেনাজ়ি বলছিলেন, “এ শহরে ইহুদি উপাসনালয় তথা সিনাগগগুলি জীবন্ত স্মারক হিসেবে অটুট রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।” শিলং ও কলকাতায় ঘুরে-ফিরে থাকা অ্যাশকেনাজ়ি বললেন, “আগের মতো ইহুদিদের বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান না-হলেও আমরা চাই নিয়মিত প্রার্থনা সভা, ইহুদিদের অনুষ্ঠান এখানে বজায় থাকুক। বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত থেকে কলকাতায় আসা ইহুদিরাও যাতে সব সময়ে প্রার্থনার সুযোগ পান। আমরা চাই, মাসে অন্তত বার দুই-তিন র্যাবাই বা পুরোহিতেরা কলকাতার সিনাগগে আসুন।” ইহুদি বিধি মতে পবিত্র এবং আহারের উপযোগী বা ‘কোশের’ তকমাপ্রাপ্ত খাবার যাচাইয়ের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাজের সূত্রে এখন র্যাবাইরা নিয়মিত আসছেন কলকাতায়। ফলে বহু বছর বাদে প্রার্থনাসভা বা সার্ভিসের অনুষ্ঠান দেখছেন এ শহরের ইহুদিরা।
ইহুদি নববর্ষ বা অন্য পার্বণও দেশ-বিদেশের অতিথিদের এনে কলকাতার সিনাগগে পালন করার পরিকল্পনা চলছে। বছর ছয়েক হল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সহযোগিতায় তিনটি সিনাগগই জরাজীর্ণ দশা থেকে সারানো হয়েছে। এখন নিয়মিত উপাসনা চালু করাই লক্ষ্য। ইহুদিদের সাপ্তাহিক বিশ্রামের দিন (সাবাথ) শনিবারের আগের বিকেলে সূর্যাস্তের আগে প্রতি সপ্তাহে তিনটি সিনাগগে ঘুরে তেলের দীপ জ্বালান ৭৬ বছরের বৃদ্ধা ক্যালকাটান জো কোহেন। তাঁর আগে এ কাজ করতেন নাহুমের প্রয়াত কর্তা ডেভিড নাহুম। কলকাতার ইহুদিদের কমিউনিটি অ্যাফেয়ার্সের সচিব শ্রীমতি কোহেনেরও আশা, নতুন করে শুরু হওয়া প্রার্থনাসভা সিনাগগে প্রাণ সঞ্চার করবে। এত সহজে নিভে যাবে না কলকাতায় ইহুদি অস্তিত্বের দীপশিখা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy