গতিময় রাজপথ, দু’পাশে ঔপনিবেশিক স্থাপত্য— ব্যস্ত রবীন্দ্র সরণির কোলাহল, টানা রিকশার ঠংঠং শব্দ আর নতুন বাজারের সারিবদ্ধ পিতল-কাঁসার দোকান। তারই গা ঘেঁসে শুরু হয়েছে আমার পাড়া পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট।
এ পাড়ার ব্যাপ্তি রবীন্দ্র সরণি থেকে যদুলাল মল্লিক রোডের মোড় পর্যন্ত। ও দিকে মোড় পেরিয়ে রাস্তাটা মিশেছে মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে। পাশের পাড়াটা প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিট।
কখনও বিক্ষিপ্ত, কখনও সারিবদ্ধ বাড়িগুলো অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে যেন কাল গুনছে। আমাদের বাড়ির সামনেই যদুলাল মল্লিকের জীর্ণ নহবতখানা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। পাশেই খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়ি, কিছুটা দূরে হরকুটির আর ও পাড়ায় মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রাসাদ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ টেগোর ক্যাসল। সব মিলিয়ে সেকালের একটি অভিজাত বনেদি পাড়া।
আর আজ? সেই পাড়াটাকেই চিনতে কষ্ট হয়। বাইরের চেহারাটা খুব একটা না বদলালেও, বদলেছে পাড়াটার পরিবেশ। এখন পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গাড়ির পার্কিং। এক এক সময় গাড়ি নিয়ে পাড়ায় ঢুকতে বেরোতে সমস্যা হয়। হাঁটাচলা করাও কষ্টসাধ্য। কিছু বাড়িতে গুদাম থাকায় মাঝে মধ্যেই পণ্যবাহী গাড়ি থেকে জিনিসপত্র ওঠানামার জন্য পরপর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর তখনই যান-যাতনার কর্কশ আর্তনাদ অসহ্য হয়ে ওঠে। এটা এ পাড়ায় এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন।
ক্রমেই কমছে এ পাড়ায় বাঙালি বাসিন্দার সংখ্যা। তার পরিবর্তে আসছেন অবাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষ। বেড়ে চলা বাণিজ্যিক প্রভাবে পাড়ার ঘরোয়া পরিবেশটা হারিয়ে যাচ্ছে। তবু এ পাড়ায় বাঙালি-অবাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। একে অপরের সঙ্গে রয়েছে সুসম্পর্ক। বিপদে আপদে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ান।
পাড়ায় বেশ কিছু ভাল পরিবর্তন এসেছে। জোরালো আলো বসেছে। রাস্তার অবস্থাও ভাল। এখন নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয়। স্থানীয় কাউন্সিলর ইলোরা সাহা যোগাযোগ রাখেন, গুছিয়ে ভাল বক্তৃতাও রাখেন। বর্ষায় আশেপাশের এলাকায় জল জমলেও, এখানে জমে না।
এলাকার বাজারটা নামে নতুন বাজার হলেও ঘিঞ্জি এবং পুরনো। বাজারটার একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। এক দিকে দশকর্মা ভান্ডার, বিয়ের তত্ত্বের জিনিসপত্র, কাপড়ের দোকান, মিষ্টির দোকান অন্য দিকে আনাজ-পাতির বেচাকেনা। পিতল-কাঁসার দোকানে আজও কিছু মানুষ বাসনে বাটালি দিয়ে ঠুকে ঠুকে ক্রেতার নাম লিখে দেন। এ ভাবেই বহু পুরনো একটা পেশা আজও টিকে আছে।
আসলে অতীত আর বর্তমানের মাঝে এই পাড়াটা একটা যোগসূত্র। এ পাড়ার পুরনো বাড়িগুলির স্থাপত্য বৈচিত্র আজও আকৃষ্ট করে দেশবিদেশের বহু মানুষকে। অজানা কীসের টানে স্মৃতিমেদুর হয়ে তাঁরা এই বাড়িগুলি দেখতে আসেন, ছবি তুলে রাখেন অধীর আগ্রহে। কেউ কেউ আবার এই বাড়িগুলিতে ঢুকে আলাপ করে, ফেলে আসা দিনের কত না স্মৃতি আর ইতিহাস জেনে নিতে চান।
পাথুরিয়াঘাটার রামলোচন ঘোষের পরিবারে আমার জন্ম ১৯৩৫-এ। আজ আট পুরুষ ধরে আমরা এই পাড়ার বাসিন্দা। রামলোচন ও তাঁর দাদা রামপ্রসাদ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান। আমার বাবা ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষ এবং দাদা মন্মথনাথ ঘোষ ছিলেন কলকাতার সঙ্গীত জগতের পথিকৃৎ। ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা।
এই পাড়াটা বহু সঙ্গীতের আসরের সাক্ষী। এক কালে পাড়ার পুরনো পরিবারগুলিতে ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চা হত। সঙ্গীতের আসরে আসতেন দেশের বিখ্যাত সব সঙ্গীতশিল্পীরা।
তেমনই এ পাড়ার দুর্গাপুজো আরও এক আকর্ষণ। পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লির পুজোর পাশাপাশি এ পাড়ার সাবেক বাড়ির পুজো দেখতে আজও অসংখ্য মানুষ ভিড় করেন। এ বাড়িতে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেছিলেন রামলোচন ঘোষ। সে কালে পুজো দেখতে এসেছিলেন সস্ত্রীক ওয়ারেন হেস্টিংস। এ ছাড়াও খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়ি এবং হরকুটিরের দুর্গাপুজো উল্লেখযোগ্য।
পাড়ায় ওই যে বাঙ্গুর ধর্মশালা, ওটাই ছিল রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি। তাঁর ছিল দেশ বিদেশের নানা রকমের বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ। পরে বাড়িটি কিনেছিলেন ব্যবসায়ী রাধাকৃষ্ণ সানথালিয়া। তিনি ছিলেন শৌখিন মানুষ, ছিল গানবাজনার শখও। মাঝে মাঝেই দেখতাম সকালে একজন লোক রাধাকৃষ্ণ সানথালিয়াকে তেল মালিশ করতেন আর সেই সময় দামোদর মিশ্র হারমোনিয়াম বাজাতেন। আজ ধর্মশালার অস্তিত্ব বোঝা যায় ২১-এ জুলাইয়ের সমাবেশের আশেপাশে। যখন সেটা হয়ে ওঠে অসংখ্য মানুষের আশ্রয়স্থল। তেমনই পাশের পাড়ায় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিখ্যাত টেগোর ক্যাসলকে আজ চিনতে কষ্ট হয়। পুরনো রূপটাই হারিয়ে গিয়েছে।
সময়ের সঙ্গে এই পাড়ার খেলাধুলোর পরিবেশটা অনেকটাই বদলেছে। এখন খেলাধুলোয় ছোটদের তেমন আগ্রহ দেখি না। আমরা ছেলেবেলায় ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলতাম জোড়াবাগান পার্ক, রবীন্দ্রকাননে, বাড়িতে কিংবা পাশের বাড়ির পিছনের মাঠে।
ছোটবেলায় পাড়ায় জ্বলত গ্যাসের আলো। রাস্তায় চলত ঘোড়ার গাড়ি। তখন পাড়ায় আসত কুলফিওয়ালা, খাঁচায় পাখি নিয়ে সেই পাখিওয়ালা। তাঁরা কি সব হারিয়ে গেল?
আগে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন পাথুরিয়াঘাটায় প্রচুর ঘুড়ি উড়ত। সেটাও আগের তুলনায় কমে এসেছে। তেমনই কালীপুজোর সন্ধ্যায় আকাশটা ফানুসে ফানুসে ভরে যেত। এখন সেটাও দিনে দিনে কমে আসছে।
পাড়ার সেই আড্ডার পরিবেশটাও আজ আর খুঁজে পাই না। কোথায়ই বা সেই সব আড্ডা দেওয়ার মানুষগুলো! এক এক সময় মনে হয়, পুরনো বাসিন্দাদের কাছে পাড়া মানে শুধু একটা থাকার জায়গা ছিল না। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, প্রতিবেশী আরও অনেক কিছু...। আর যাঁরা নতুন এসেছেন তাঁদের কাছে পাড়া মানে শুধু থাকার আর অর্থ রোজগারের জায়গা। পাড়াটাকে তাঁরা হয়তো ভালবাসতে পারেননি।
তবু নতুনের ভিড়ে নিজের পুরনো অস্তিত্ব বজায় রেখে আজও আমাদের পাড়াটা কিছুটা স্বতন্ত্র। যেন অতীত আর বর্তমানের মাঝে একটা সেতু।
লেখক রামলোচন ঘোষের পরিবারের সদস্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy