প্রতীকী ছবি।
‘আপনি মহামেডান তো?’ ফোনে সামান্য থমকে প্রথম প্রশ্ন এল। উত্তর না-দিতে দিয়েই সটান মতামত, ‘‘আপনি যাঁর কাছ থেকে নম্বর পেয়েছেন, সে তো মহামেডান। কিন্তু সব জায়গায় ঘর দিতে পারব না।’’
মুহূর্তে পাল্টে গেল চেনা শহরটা। কারণ, যে শহর নাখোদা মসজিদের মিনারে সবুজ আলো দেখে জানতে পারে ইদের চাঁদ উঠেছে, যে শহরে খাদ্যরসিকদের গন্তব্য হল বিরিয়ানির রেস্তরাঁ আর সেই সব শেফদের অধিকাংশই মুসলিম, সে শহরে ‘মহামেডান’ হলে ‘সব জায়গায়’ ঘর পাওয়া যাবে না?
অনেক দিন থেকেই অভিযোগ ছিল যে, এ শহরে ঘর দেওয়ার আগে ধর্ম কী, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ‘শামিম খান’ হয়ে বাড়ি ভাড়া চাওয়া হবে।
প্রথমে ঘর খোঁজা গেল যাদবপুরে। এক পরিচিত মুসলিম বান্ধবীর মাধ্যমে ‘ব্রোকার’ সুমিত মিত্রকে (নাম পরিবর্তিত) ফোন এবং ‘মহামেডান’ প্রসঙ্গ শোনা। কেন মহামেডান হলে সব জায়গায় ঘর ভাড়া পাব না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হঠাৎ তুই-তোকারিতে নেমে এলেন সুমিতবাবু। স্নেহচ্ছলেই। বললেন, ‘‘কিছু মনে করিস না ভাই। তোকে সব জায়গায় ঘর ভাড়া দিতে পারব না। অনেকেই মহামেডানদের ঘর ভাড়া দিতে চান না।’’ কারা চান না? তাঁর উত্তর, ‘‘কেউই চান না। তোর জন্য আলাদা জায়গা দেখে দেব।’’ অ্যাডভান্স দিতে রাজি আছি, টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা নেই, বৈধ পরিচয়পত্র রয়েছে, সে সব শুনেও তাঁর বক্তব্য, ‘‘না ভাই। কিছু মনে করিস না। তোর জন্য আলাদা জায়গা দেখে দেব।’’
একই অভিজ্ঞতা হল প্রদীপ লাহার (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়। প্রদীপবাবুও বাড়ি-ফ্ল্যাট ভাড়া সংক্রান্ত ব্যবসায় জড়িত। প্রথমে তিনিও প্রবল উৎসাহে জানালেন, বাড়ি জোগাড় করে দেবেন। তবে শামিম খান নামটা শোনার পরে বললেন, ‘‘কিছু মনে করবেন না। অনেক জায়গাতেই মুসলমানদের ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না।’’ নিজের পছন্দের জায়গায় ঘরভাড়ার জন্য জোরজার করতে বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘‘শুনুন। আপনার মতোই এক জনকে বাড়ি ভাড়া করিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির মালিক জানিয়েছিলেন, বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে। কোনও মুসলমানকে ঘর ভাড়া দেবেন না। ওই ছেলেটিকে আর একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই বাড়ির মালিকও বলেছিলেন, বাড়িতে বাবা-মা রয়েছেন। ঠাকুর রয়েছে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারবেন না।’’ তবে প্রদীপবাবুও আশ্বাস দিলেন, অন্যত্র তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন। কিছু দিন পরে ফোন করতে হবে।
আর এক জন ‘ব্রোকার’কে ফোন করা হলে নাম শুনে আপত্তি করেননি। তবে বললেন, ‘‘একটু অসুবিধা হবে। এর আগে নিজের রিস্কে একজন মুসলিম ছেলেকে বাড়ি ভাড়া করিয়ে দিয়েছিলাম। সে আমার অনেক দিনের কাস্টমার। আপনাকেও করিয়ে দেব।’’
সুমিতবাবু বা প্রদীপবাবুরা স্পষ্ট যা বলার বলেছেন। অনেকেই বলেন না। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের বেশ কয়েক জন ‘ব্রোকার’, কত বাজেট, কত জন থাকব ইত্যাদি প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু নামটা শোনার পরে থমকেছেন। তার পরই— ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিটেলস বলছি’। ফোন আর আসেনি। গবেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘‘অনেক জায়গায় বাড়ির মালিককে বোঝাতে হয়, এঁরা তেমন মুসলিম নন! এঁরা বাংলায় কথা বলেন, এঁরা এখানকারই। অনেক জায়গায় ঘর ভাড়া কেন দিচ্ছি না, সেই কারণটাও পরিষ্কার বলা হয় না। আসল কিন্তু ধর্মীয় কারণই।’’
যাদবপুরে ঘর ভাড়া নিতে গিয়েছিলেন ছাত্রী তানভি সুলতানা। কথাবার্তা চূড়ান্তও হয়ে যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিক যখন জানতে পারেন যে, তানভি মুসলিম, তখন আর রাজি হননি। তানভি বলছেন, ‘‘বাড়ির মালিক মুখের উপরে বলে দিয়েছিলেন, কিছু মনে করো না। তুমি তো মুসলিম। বাড়ি ভাড়া দিতে পারব না!’’
একই অভিজ্ঞতা চিকিৎসক রেজাউল করিমেরও। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ঘর ভাড়া পাননি তিনিও। অতীতের সে তিক্ত অভিজ্ঞতা কাটিয়ে রেজাউল এখন বলছেন, ‘‘আমার খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরে অনেকেই ফোন করে বলেছিলেন, আমার বাড়িতে এসে থেকে যান!’’ নাখোদা মসজিদের ট্রাস্টির সদস্য মহম্মদ ইকবাল বলছেন, ‘‘অনেক জায়গাতেই এমন হচ্ছে শুনেছি। এ শহর কিন্তু আমাদের চেনা নয়! সম্প্রীতির শহরকেই আমরা চিনি।’’
ঠিকই! প্রত্যাখ্যানের পরেও যে শহর ফিরিয়ে নেয়, সে শহরই তো আমাদের চেনা। ‘মহামেডান? তোমার জন্য আলাদা জায়গা দেখব’, এ শহরকে চিনি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy