Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

‘মুখে হাসি ফোটাতে টাকা তো লাগেই!’

সন্তানের আকাঙ্ক্ষা। কলকাতা জুড়ে ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। সেখানে হচ্ছেটা কী? কোন খাতে কত খরচ, তা জেনে এগোনোর উপায় নেই। এক ক্লিনিকের রিসেপশনিস্ট যেমন বললেন, ‘‘টেস্ট এবং ওষুধের নাম বললে আপনি কি বুঝবেন? বরং স্যার যেমন বলেন, পরপর তেমন করলে আপনারও সুবিধে!’’

সন্তানের চেষ্টায় চিকিৎসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা জলাঞ্জলি দিতে হয় বলে অভিযোগ অনেকেরই।

সন্তানের চেষ্টায় চিকিৎসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা জলাঞ্জলি দিতে হয় বলে অভিযোগ অনেকেরই।

সুচন্দ্রা ঘটক ও শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৮ ০২:৪৯
Share: Save:

ডাক্তারবাবু, টাকার অঙ্ক বেড়েই যাচ্ছে। এ বার ফল মিলবে তো?

ধৈর্য না ধরলে হবে?

এত টাকা কোথায় পাই!

ভাববেন, যত দিন হাতে টাকা আসছে না, তত দিন আপনার সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সময় আসেনি।

ঘটনাটি কয়েক বছর আগের। কলকাতার এক নামী ‘ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক’-এ এক সন্তানপিপাসুর সঙ্গে চিকিৎসকের এমন কথোপকথন শুনে চমকে উঠেছিলেন সেই ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আর এক দম্পতি।

পরিস্থিতি যে বদলায়নি, তা দেখা গেল শহরের নানা প্রান্তের কয়েকটি ‘ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক’ ঘুরে। সন্তানের চেষ্টায় চিকিৎসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা জলাঞ্জলি দিতে হয় বলে অভিযোগ অনেকেরই। তাই পরিচয় গোপন করে পৌঁছনো গিয়েছিল ওই সব ক্লিনিকে।

দক্ষিণ কলকাতার ঝাঁ চকচকে ক্লিনিকে ঢুকেই দেখা গেল, হত্যে দিয়ে বসে এক ঝাঁক দম্পতি। তাঁদের পাশ কাটিয়ে পৌঁছনো গেল ছোট টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসা এক যুবকের সামনে। জানানো হল, বিয়ের ৯ বছর পরেও সন্তান হয়নি। তাই অসম থেকে কলকাতায় আসা উন্নত চিকিৎসার আশায়। যুবকের উপদেশ, ‘‘স্যরকে দেখিয়ে নিন। সব সমস্যা মিটে যাবে। আজ উনি নেই। তিন দিন পরে চলে আসুন।’’

আরও পড়ুন: ‘ক্যানসারে তো ভুগছি, এ বার কি শিয়রে ডেঙ্গিও!’

কবে নাম লেখাতে হবে? যুবকের উত্তর, ‘‘যে কোনও দিন সকালে এলেই হবে। নাম লেখানোর দরকার নেই।’’ তবে চিকিৎসকের ফি বাবদ ২০০০ টাকা আনলেই হবে না। পকেটে অন্তত পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা রাখা জরুরি। ‘‘ডাক্তারি পরীক্ষা, ইঞ্জেকশনের বেশ দাম। প্রথম দিন থেকেই চিকিৎসা শুরু হয়। তাই বেশি করে নিয়ে আসাই ভাল,’’ বললেন ওই যুবক। প্রথমেই এত? মুচকি হেসে যুবক বলেন, ‘‘দেখেছেন, এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের কারও মুখে হাসি নেই। মুখে হাসি ফোটাতে ওই টাকা তো লাগেই।’’

পরের গন্তব্য শহরের আর এক প্রান্তের ক্লিনিক। সেখানকার কর্মীর আশ্বাস, ‘‘আগেই টাকার কথা ভাববেন না। কোন পদ্ধতিতে কাজ হবে, সেটা ঠিক হোক।’’ কত লাগবে? উত্তর, ‘‘অনেক ধরনের ইঞ্জেকশন লাগে। এক-একটির এক-এক রকম দাম।’’ কথা এগোতেই বোঝা গেল, এখানে গুরুত্ব নেই পুরনো রিপোর্ট কিংবা প্রেসক্রিপশনের। রিসেপশনের কাজ যে কোনও উপায়ে চিকিৎসা শুরু করানো!

তবে কোন খাতে কত খরচ, তা জেনে এগোনোর উপায় নেই। এক ক্লিনিকের রিসেপশনিস্ট যেমন বললেন, ‘‘টেস্ট এবং ওষুধের নাম বললে আপনি কি বুঝবেন? বরং স্যার যেমন বলেন, পরপর তেমন করলে আপনারও সুবিধে!’’

শহরের অন্য নামী চিকিৎসকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতেই গড়ায় অন্তত মাস তিনেক। এ সব ক্লিনিকে ঘুরে বোঝা গেল, এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ঝক্কি নেই। কিছুটা টাকা নিয়ে চলে গেলেই শুরু হবে ‘ইঞ্জেকশন’। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসাকেন্দ্রে কথা বলতে গেলেই প্রথম ওঠে ইঞ্জেকশন প্রসঙ্গ। শহরতলির এক ক্লিনিক থেকে ফোনে সাফ কথা, ‘‘আপনার শরীর, আপনার টাকা। আপনি চাইলে শরীর বাঁচাতে ভাল ইঞ্জেকশন নেবেন।’’

রয়েছে রকমারি প্যাকেজও। বাইপাসের ধারে এক ক্লিনিকে রিসেপশনিস্ট এগিয়ে দিলেন ‘মেনু কার্ড’। দেওয়ালে টাঙানো বোর্ডেও পরপর প্যাকেজ— ৯৯ হাজার থেকে আড়াই লক্ষেরও বেশি। পাশে টেস্ট এবং চিকিৎসা পদ্ধতির বিবরণ। সাধারণের পক্ষে বোঝা সহজ নয় সে সব নাম। যদি ফল না মেলে? চিকিৎসকেরাই তো বলেন, এই পদ্ধতিতে সাফল্যের হার মাত্র ৩০ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে কি জলেই যাবে টাকা? ‘‘বারবার নতুন প্যাকেজ বেছে নেওয়া যাবে,’’ রিসেপশন থেকে সটান উত্তর।

সব শুনে শহরেরই এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসক বলছেন, ‘‘যে সব প্যাকেজের জন্য এক লক্ষ, দেড় লক্ষ টাকা চাওয়া হয়, চিকিৎসক চাইলেই তা হতে পারে অর্ধেক খরচে। এমনিতেই এই ধরনের চিকিৎসায় নিশ্চয়তা নেই তেমন। কিন্তু এক বার শুরু করলে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। চিকিৎসকদের সিন্ডিকেট আশ্বাসের আড়ালে খরচটা বাড়িয়েই দিতে চায়।’’

সে দাম কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকারও? কোনও অভিযোগ পেলে বিষয়টি ভেবে দেখবেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী। আপাতত তাঁর বক্তব্য, ‘‘এক এক দোকানের চায়ের দাম তো এক এক রকমই হয়। কে কী ভাবে চিকিৎসা করবেন, তা কি বেঁধে দেওয়া যায়? তা ছাড়া নিজের চিকিৎসায় কে কত খরচ করবেন, তা-ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Artificial Reproduction IVF Infertility Clinic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE