অ্যাপোলো-কাণ্ড, সরকারের নয়া স্বাস্থ্য বিল, স্বাস্থ্য কমিশন— প্রায় প্রতি দিন এ দিক-ও দিক থেকে আসতে থাকা চিকিৎসায় গাফিলতির নানা অভিযোগ। সব মিলিয়ে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক এখন বহু ক্ষেত্রেই কার্যত তলানিতে। এরই মধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার, বহু ক্ষেত্রে তাঁদের ছবি দিয়ে বয়কট করার ডাক সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসক সমাজের একটা বড় অংশকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর শেষ কোথায়? প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। প্রশ্ন তুলেছেন, নাম এবং ছবি ব্যবহার করে এই প্রচারও কি এক অর্থে ‘সাইবার-অপরাধ’ নয়?
শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকের ছবি এখন ছেয়ে গিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। ঠিক যে ভাবে ফেরার অপরাধীর পোস্টার ছাপিয়ে তাদের খুঁজে বার করার চেষ্টা হয়, অনেকটা সেই আদলেই তাঁদের ছবি এবং তাঁদের সম্পর্কে সতর্কবার্তা ঘুরছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দেওয়ালে।
কখনও মৃতের পরিবারের সদস্যেরা, আবার কখনও ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনওরকম যোগ না থাকা বহু মানুষ এই পোস্টগুলি করছেন। সেই সব পোস্টের নীচে যথেষ্ট রূঢ় ভাষায় উষ্মা প্রকাশ করছেন বহু মানুষ। কার্যত ‘খুনি’র তকমা দিয়ে ডাক্তারদের রাস্তায় টেনে এনে মারধর করার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এই প্রবণতা বন্ধ করতে প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া উচিত। কোথাও অভিযোগ জমা পড়ল কি পড়ল না, তার আগেই এক শ্রেণির মানুষ নিজেরাই বিচার করে কাউকে অপরাধী চিহ্নিত করে বিচারের ভার নিয়ে নিচ্ছেন। এটা আটকানোর দায় প্রশাসনেরও।
বিষয়টি যে এক অর্থে ‘সাইবার অপরাধ’, তা মেনে নিয়েছেন গোয়েন্দা প্রধান বিশাল গর্গ-ও। তিনি বলেন, ‘‘লিখিত অভিযোগ পেলে আমাদের পক্ষে সুবিধা হয়। কেউ যদি অভিযোগ করেন, তা হলে আমরা আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’’
সরকারি চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রবণতায় হতাশ। তাঁর কথায়, ‘‘আগে মিডিয়া ট্রায়াল হত। এখন সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। যে কোনও সময়ে যে কোনও ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে আমাদের।’’ তবে সুবীরবাবু মনে করেন, খুব কম ক্ষেত্রেই
রোগীর পরিজনেরা এই ধরনের প্রচারে সামিল হন। তিনি বলেন, ‘‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে। কিছু লোক ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এ সব করছে বলে মনে হয়। রাগ, ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু এটা তার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না।’’
একই কথা বলেছেন শল্য চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এটাই একমাত্র সত্য নয়। এখনও এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এই কুৎসার বিষয়টা ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। ইদানীং আমার বহু রোগী এসে হলেন, ‘ডাক্তারবাবু এ সব কী হচ্ছে? আপনারা কেন প্রতিবাদ করছেন না?’ আসল কথা হল, ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের এই অস্থিরতা শুধু আমাদের এখানকার নয়, সারা বিশ্বেরই ছবি।’’
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও এই প্রবণতায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। তাঁদের বক্তব্য, বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক শ্রেণির চিকিৎসক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু বিষয়টির অতি সরলীকরণ চলছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এখন খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। সেখানে এ ভাবে ছবি-সহ কুৎসা রটালে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই সেই চিকিৎসকদের ‘একঘরে’ করার চেষ্টা চলছে।
চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল-ও মনে করছে, যে ভাবেই হোক কুঞসা ছড়ানোর এই নতুন প্রবণতাকে রুখতে হবে।
তাদের বক্তব্য, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। তার দ্রুত নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্তও স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু এ বার ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের তলানিতে পৌঁছনো ঠেকাতেও কিছু পদক্ষেপ জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy