অর্ক মণ্ডলকে নিয়ে বুধবার এন আর এস থেকে ফেরত যাচ্ছেন তার মা।
কেউ মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে প্রায় নেতিয়ে পড়েছে । কারও হৃদযন্ত্রে ফুটো থাকায় অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। কেউ আবার জিভে ঘা থাকায় মুখে খাবার তুলতে পারছে না।
এমনই বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে বুধবার সকাল থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরেও চিকিৎসা পেল না অসংখ্য শিশু। হাত জোড় করে কান্নাকাটি করেও সন্তানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে শেষমেশ ক্লান্ত শিশুকে কোলে তুলে বাড়ির পথেই পা বাড়ালেন বাবা-মায়েরা।
রাজ্য জুড়ে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির জেরে বুধবার অসংখ্য শিশুর রোগ-যন্ত্রণায় ছটফট করার সাক্ষী থাকল কলকাতা। যদিও এই শহরকে ভরসা করেই পাঁচ মাসের শিশু কন্যাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন বছর বাইশের গৃহবধূ সুরেবা খাতুন। জন্মের পরেই ধরা পড়ে, একরত্তি মেয়েটার হৃদ্যন্ত্রে ফুটো রয়েছে। আর তাই ছোট্ট সুহানার চিকিৎসার জন্য সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেন াত্রা করে ২০০ কিলোমিটার দূরে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাজির হয়েছিলেন সুরেবা। ভিন্ রাজ্যে কাজ করা শ্রমিকের স্ত্রী ওই তরুণী জানান, মঙ্গলবার রাতে যখন তিনি হাসপাতালে এসে পৌঁছন তখন দেখেন, গেট বন্ধ করার তোড়জোড় চলছে। ভিতর থেকে সবাইকে বার করে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
হয়রানি: রিয়া খাতুনকে নিয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বাইরে তার দিদিমা।
অত রাতে কী করবেন বুঝতে না পেরে রাতভর সুহানাকে কোলে নিয়েই হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে বসেছিলেন সুরেবা। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসায় তাঁর সঙ্গী বলতে, বৃদ্ধা শাশুড়ি ও এক মহিলা প্রতিবেশী। বুধবার সারা দিন হাসপাতাল চত্বরে ঘুরে বেড়ি য়েও মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে পা বাড়িয়েছেন সুরেবা। বললেন, ‘‘মেয়ের শ্বাস নিতে খুব অসুবিধে হয়। ঠিক মতো দুধ খাওয়াতে পারি না। মুর্শিদাবাদ জেলা হাসপাতাল থেকে কলকাতায় পাঠাল। কিন্তু এখানে তো কেউ দেখলেনই না।’’
মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে থাকলেও চার বছরের রিয়া খাতুনকে প্রথমে দেখেননি কোনও চিকিৎসকই। বাবা-মা হারা ওই শিশুকে নিয়ে বুধবার সকালেই মালদহ থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এসেছেন তার দিদিমা ও মামা। গোটা সকাল হাসপাতালের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হন্যে হয়ে ঘুরলেও মেলেনি চিকিৎসা। বরং হাসপাতালের বাইরের ফুটপাতে নাতনির মাথার কাছে বসে কান্নাকাটি করেই দিন কেটেছে দিদিমা হাসফুল বেওয়ার। বিকেলে ভাগ্নিকে কোলে তুলে নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করার পরে জুনিয়র চিকিৎসকেরা রিয়ার রিপোর্ট দেখলেও তাকে ভর্তি করা যায়নি। বরং নিয়ে যেতে বলা হয় অন্য হাসপাতালে। যদিও বিকেলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত, বি সি রায় শিশু হাসপাতাল, এসএসকেএম ও বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেসে গিয়েও চিকিৎসা মেলেনি সেই শিশুর।
সকালে বি সি রায় হাসপাতালে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে অর্ক মণ্ডল নামে সাত বছরের এক শিশু। সেখান থেকে তাকে এন আর এসে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে আন্দোলনের চেহারা দেখে কাঁদতে থাকেন শিশুটির মা। শেষে এক পুলিশকর্মী ওই পরিবারটিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে পাঠান।
ভাঙড়ের বাসিন্দা রূপা বিবি এ দিন সকালেই ছেলে আল আমিন মোল্লাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বি সি রায় হাসপাতালে। জিভে ঘা থাকায় মুখে কিছু দিতে পারছে না ছোট্ট ছেলেটা। রূপা বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবুদের বললাম ছেলেকে ভর্তি করতে চাই। কিন্তু ওঁরা জানালেন যে ভর্তি করলেও ওঁরা কিছু করতে পারবেন না।’’ একই অভিযোগ ডোমজুড়ের প্রতিমারও। বললেন, ‘‘কোথা থেকে ওষুধ নেব জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসছে যেখান থেকে খুশি নাও।’’
জ্বরে কাবু হাতিয়াড়ার আট বছরের আনিসা মহসিনার মা শাহিদা বিবির কান্নাকাটির জেরে অবশ্য এ দিন ওই হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসা পেয়েছে ওই বালিকা। শাহিদার কান্নাকাটি এবং পুলিশের হস্তক্ষেপে একটা ঘর খুলে ওই বালিকাকে দেখে কয়েকটি ওষুধ লিখেই দায় সেরেছেন চিকিৎসকেরা। আর এক শিশুর দিদিমা মালা ভুঁইয়ার কথায়, ‘‘নাতির মঙ্গলবার রাত থেকে জ্বর। জরুরি বিভাগে দেখলাম এক মহিলার থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হল। আমাকে বলা হল, বাইরে থেকে যে ওষুধ কিনেছি সেটা খাওয়াতে।’’
মুর্শিদাবাদের রানিনগরের বছর দুয়েকের শিশুটি অবশ্য প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগলেও কোনও ওষুধ জোটেনি তার। বুধবার ভোরেই পরিজনেরা তাকে নিয়ে পিজি-তে এসে পৌঁছলেও বিকেল পর্যন্ত মেলেনি চিকিৎসা। অগত্যা জরুরি বিভাগের সামনে অচৈতন্য মেয়েকে কোলে শুইয়ে চোখের জল মুছে মা সাদেয়া বিবি বললেন, ‘‘ডাক্তারদের মারা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমার বাচ্চাটার কী দোষ?
ডাক্তারবাবুদের কাছে অনুরোধ আমার মতো অনেক মা সন্তানদের চিকিৎসা করাতে না পেরে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দয়া করে একটু সদয় হোন।’’
—নিজস্ব চিত্র।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy