Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Hooligan

‘কেউ অন্য দিকে যাচ্ছে মনে হলে টাকা বাড়িয়ে দে’

অতিমারির জেরে বদলেছে শহরজীবন। ভোটের আগে সেই বদলে যাওয়া জীবনের অনুপাতেই নিজেদের ভাগের হিসেবও বদলে নিচ্ছেন এলাকার নেতা-দাদারা। আপাতত সবটাই ঠিক হচ্ছে ভোটের হাওয়ার অভিমুখ বুঝে।হিসেব এমন যে, দাদা আপাতত যে দিকে ঝুঁকে, সে দিকে থাকলে দিনপ্রতি তোলার টাকার দু’গুণ দিতে হচ্ছে হকারকে।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:১৬
Share: Save:

“হাওয়া বুঝে অন্য দিকে ঝুঁকছ? আর ৫০ টাকা নয়, এ বার রোজ ২০০ টাকা করে লাগবে। বাড়াবাড়ি করলে দোকানটাই তুলে দেব।”— ফুটপাতে বসা চার হকারকে ডেকে এ ভাবেই শাসানি দিয়ে দাদা এর পরে অনুগতদের বলেন, “ভোটার পার্ট ধরে ধরে কাজের ফুটপাতের তালিকা তৈরি কর। সেখানকার হকারদের ডেকে পাঠা। আগের টাকায় আর হবে না। কেউ অন্য দিকে যাচ্ছে মনে হলেই টাকা আরও বাড়িয়ে দে। ওটাই মোক্ষম ওষুধ।”

হিসেব এমন যে, দাদা আপাতত যে দিকে ঝুঁকে, সে দিকে থাকলে দিনপ্রতি তোলার টাকার দু’গুণ দিতে হচ্ছে হকারকে। আর দাদার বিপরীতে গেলেই সেই তোলার পরিমাণ বাড়ছে চার বা পাঁচ গুণ! শ্যামবাজার মোড়ের এক হকারের অভিজ্ঞতা, “দু’দিন অন্য একটা দলের মিছিলে গিয়েছিলাম। কেউ বা কারা সেই ছবি তুলে এলাকার দাদার কাছে পাঠায়। ওই দাদাই আমায় স্টল করতে দিয়েছিলেন। এখন তিনি বলেছেন, ভোটে তোরা জিতলে তবেই দোকান করবি, তার আগে নয়।” টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটি খাবারের স্টলের মালিককে এক দাদার অনুগতেরা বলেছেন, “টিভি দেখে দল ঠিক করছিস? তাহলে নিজের রোল-চাউমিন নিজেকেই খেতে হবে।” সে দিনের বৈঠকেই দাদার ছেলেদের জন্য বিনামূল্যে ৬০টি রোল পাঠানোর হুকুম জারি হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, “আগে রোজ হিসেবে ৫০ টাকা দিলেও এখন থেকে ১৫০ টাকা লাগবে।”

উল্টোডাঙার কাছে ফোয়ারা তৈরির জন্য ফুটপাত থেকে ঠাঁইহারা করা হয়েছিল এক ডিম বিক্রেতাকে। তাঁকে বলা হয়েছে— “লকডাউনে টাকা নিইনি। এখন শুনছি, তোরা ফোয়ারার বিরোধিতা করছিস! প্রতি দিন ৫০ টাকা করে ধরলে সাত মাসের লকডাউনের জন্য ১০৫০০ টাকা হয়। এক বারে দশ হাজার টাকা না দিলে কোথাও দোকান দিতে দেব না।” ওই ডিম বিক্রেতা বলছেন, “টাকার অভাবে মেয়ের স্কুলের সাড়ে তিন হাজার টাকাই জমা করতে পারছি না। অত টাকা তোলা দেব কোথা থেকে! দিদিকে বলো-য় জানানোর জন্য অনেক বার ফোন করেছি। কিন্তু কিছুই হয়নি এখনও।”

ভোটের আগে দাদার নিয়ম

• অনাস্থা দেখালে তোলার পরিমাণ ৫০ টাকা থেকে বেড়ে এক লাফে ২০০ টাকা
• মতের সমর্থক হলে ছাড়, সে ক্ষেত্রে ৫০ টাকার বদলে দিতে হবে ১০০-১৫০ টাকা
• ফুটপাতের স্টলে ঘণ্টাপ্রতি ১০-৩০ টাকার প্যাকেজ চালু। সমর্থক না হলে প্যাকেজের দাম বেশি
• বহু স্টলে দু’বেলা দুই ভিন্ন হকার। দাদার প্রাপ্তি বেশি, হকারেরও লাভ
• ভোটের জেরে ফুটপাত সংস্কারের কারণে বাড়ছে সেখানে দোকান দেওয়ার খরচ

এ শুধু বিরোধী হাওয়ায় গা ভাসানোর ‘অপরাধে’ করা জুলুম নয়। এত দিন দাদাদের কল্যাণে শহরে যাঁরা ফুটপাত দখল করে দোকান করছিলেন, তাঁদের সকলকে তোলার টাকা বাড়াতে বলা হয়েছে বলে খবর। নিউ মার্কেটের এক হকারের মন্তব্য, ‘‘আগে দিনে ৫০ টাকা দিলে ফুটপাত এমনকি রাস্তার অনেকটা নিয়েও দোকান দেওয়া যেত। এখন দাদার লোকেরা বলেছেন, একশো টাকার কমে চলবে না। ভোট তহবিলের নাকি খুব চাপ!’’

অতীতেও ফুটপাত দখল করে দোকান বসানোর একাধিক অভিযোগ উঠলেও শহরের চিত্র বদলায়নি। উল্টে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের নাম ও ছবি-সহ স্টল বসেছে উল্টোডাঙা, বেলেঘাটার মতো একাধিক জায়গায়। বিতর্কের জেরে স্টল থেকে ছবি সরলেও ফুটপাত দখলমুক্ত হয়নি। কিছু জায়গায় আবার ফুটপাতের এক একটি স্টলে সময় ভাগাভাগি করে দু’জন করে হকার বসানোর নিয়মও জারি হয়েছে। লকডাউনের পরে নয়া নিয়ম চালু হয়েছে গড়িয়াহাট ফুটপাতে। এত বছর সেখানে দোকান দিতে যে ‘প্যাকেজ’ নিতে হত, তাতে দৈনিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলে স্টলের সঙ্গে আলো, বসার জায়গারও বন্দোবস্ত থাকত। কিন্তু এখন প্যাকেজে এইসব বাড়তি ‘সুবিধা’ নেই। উল্টে দাদার দেওয়া স্টল পাননি যাঁরা, তাঁদের দোকান দিতে গেলে ঘণ্টাপিছু ১০-৩০ টাকা করে গুনতে হচ্ছে! এ ক্ষেত্রেও অনাস্থা দেখালে খরচ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ঘণ্টায় ৫০-৬০ টাকা!

বেলেঘাটার এক হকারের দাবি, ‘‘গত সপ্তাহে আমায় বলা হয়েছে, আমরা নাকি অন্য দলের সমর্থক হয়ে যাচ্ছি। তাই ফুটপাতে দোকান দিতে হলে ঘণ্টায় ৫০ টাকা করে দিতে হবে। অর্থাৎ আট ঘণ্টায় ৪০০ টাকা। দিনে অত বিক্রিই হয় না, টাকা দেব কোথা থেকে!” পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন? হকারের দাবি, ‘‘যে এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে ক্লাবের ছাদ উড়ে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সেখানে হকারের কথা কে শুনবেন? দাদা বলে দিয়েছেন, যে বেশি টাকা দেবে সে-ই বসবে।’’

যদিও এমন কোনও অভিযোগ এখনও আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন কলকাতা পুরসভার হকার সংক্রান্ত বিষয়ে দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা প্রাক্তন মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক ইউনিয়নের নেত্রী দোলা সেন বলেছেন, ‘‘আমাদের দলে কোনও শ্রমিক বা হকারের থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপার নেই। কোনও হকার ভাইয়ের অভিযোগ থাকলে তিনি তৃণমূল ভবনে আমার কাছে আসতে পারেন।’’

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Hooligan Street hawkers Money
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy