রং হলুদ হোক বা সাদা, ‘যাব না’ বলায় অকুতোভয় শহরের অধিকাংশ ট্যাক্সিই।
দৃশ্য ১: বুধবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ জিপিও-র সামনে দাঁড়িয়ে বেহালার বাসিন্দা বিকাশ ঘোষ। অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে নিয়ে যাবেন চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। কিন্তু গন্তব্যস্থল শুনেই প্রত্যাখান করল তিনটি ট্যাক্সি (ডব্লিউ বি০৪ই ৭৬৮৫, ডব্লিউ বি০৪এফ ০৯৪৮ এবং ডব্লিউ বি০৪এফ ৭৫৬৯)। বৃদ্ধা তত ক্ষণে কাতরাচ্ছেন। শেষে বিকাশবাবুর সঙ্গী পাঁচ যুবক ঝুঁকি নিয়েই মাঝরাস্তায় একটি ট্যাক্সি (ডব্লিউ বি০৪এফ ২৫২৩) আটকালেন। গন্তব্য শুনে প্রথমে যাত্রী নিতে নারাজ ছিলেন তিনিও। কিন্তু ওই যুবকেরা মারমুখী হয়ে ওঠায় বিকাশবাবু ও তাঁর মাকে ট্যাক্সিতে তুলতে বাধ্য হন তিনি।
দৃশ্য ২: বুধবার হাওড়া স্টেশন যাওয়ার জন্য বিকেল সাড়ে চারটেয় বিবাদী বাগে ট্যাক্সি ধরতে দাঁড়িয়েছিলেন মানব মজুমদার। হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে যাবেন আসানসোল। প্রথমে ‘হাওড়া যাব না’ বলে চলে গেল একটি ট্যাক্সি (ডব্লিউ বি০৪ই ৬৪৩৪)। পরের ট্যাক্সিচালক (ডব্লিউ বি০৪ই ৮৫৭৯) জানালেন, তিনি মিটারে যাবেন না। ওই সময়ই বিবাদী বাগ থেকে কসবা যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন দীপায়ন সাহা নামে আর এক যুবক। তিনটি ট্যাক্সি (ডব্লিউ বি০৪ডি ৫৩০৬, ডব্লিউ বি০৪ডি ৯৯৩৫ ও ডব্লিউ বি০৪ই ৬১৪৪) প্রত্যাখান করেছিল তাঁকে।
দৃশ্য ৩: বুধবার বেলা ১১টায় কালীঘাট মন্দিরের কাছে চেতলা যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খুঁজছিলেন এক ব্যক্তি। এক ট্যাক্সিচালক (ডব্লিউ বি-০৪ডি-৩৯০৩) থামলেন কিন্তু ভাড়া হাঁকলেন ৭৫ টাকা! ‘মিটারে যাব না’, সাফ কথা ওই চালকের। সে সময় ওই ট্যাক্সির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এক পুলিশকর্মী। বিষয়টি তাঁকে জানাতেই ওই ট্যাক্সিচালককে জরিমানা করলেন তিনি।
দৃশ্য ৪: বুধবার বেলা সাড়ে তিনটে। ধর্মতলায় কাজ সেরে চিত্পুরের নাখোদা মসজিদে যাবেন বাংলাদেশের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। এসপ্ল্যানেড মেট্রোর সামনে ট্যাক্সিচালক (ডব্লিউ বি০৪এফ ৫০৯৮) প্রত্যাখান করলেন। অনুরোধ করায় জবাব এল, “৩০০ টাকা লাগবে।” বাধ্য হয়ে হেঁটেই চিত্পুরের উদ্দেশে রওনা দিলেন হাবিবুর।
দৃশ্য ৫: বুধবার বিকেল ৩টে ৪৫। ধর্মতলা থেকে মল্লিকবাজার যাবেন এক ব্যক্তি। ট্যাক্সিচালককে (ডব্লিউ বি০৪এফ ৩৭৪২) বলতেই জবাব এল, “এত কম রাস্তায় যাব না।” বিকেল ৪টে। পার্ক স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা যেতে নারাজ আর এক ট্যাক্সিও (ডব্লিউ বি২৫এফ ১১০২)।
দৃশ্য ৬: মঙ্গলবার রাত ১১টা। ধর্মতলা ভিক্টোরিয়া হাউসের কাছে ‘নো রিফিউজাল’ লেখা সাদা ট্যাক্সিকে শ্যামবাজার যেতে বলা মাত্রই জবাব এল, “এখন গ্যারাজে যাব।” অথচ ড্যাশবোর্ডে ‘গ্যারাজ’ লেখা ছিল না!
দৃশ্য ৭: মঙ্গলবার রাত ১১টা ৪৫। শ্যামবাজার মেট্রোর কাছে ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে ট্যাক্সি থামালেন এক ব্যক্তি। যাবেন দেশপ্রিয় পার্ক। চালক বললেন, “মিটারের থেকে ৫০ টাকা বেশি লাগবে।” একটু দূরে শ্যামবাজার মোড়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হলুদ ট্যাক্সি। তাদের এক জনকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এল, “শুধু হাওড়া যাবে।” কাছেই বেঞ্চে বসেছিলেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। বিষয়টি তাঁদের বলতেই এক জন হেসে বললেন, “ওরা তো হাওড়াই যাবে।”
উপরের সাতটি দৃশ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে যাত্রী প্রত্যাখানে এখন কত বেপরোয়া ট্যাক্সিচালকেরা। এই দৌরাত্ম্যে লাগাম টানতে পুলিশ কতটা সমর্থ, তা-ও স্পষ্ট শ্যামবাজারের ঘটনায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কেন এ ভাবে যাত্রী প্রত্যাখান করছেন ট্যাক্সিচালকেরা। অনেকেই বলছেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি নজরুল মঞ্চে পরিবহণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ঘোষণার অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আপনি (ট্যাক্সিচালক) যেতে পারছেন না। নিশ্চয়ই আপনাদের তা বলার অধিকার আছে।” ট্যাক্সি প্রত্যাখানের জরিমানা তিন হাজার টাকা থেকে ১০০ টাকায় নামিয়ে এনেছেন তিনি। সেই ঘোষণাই যে প্রত্যাখানে এখন ট্যাক্সিচালকদের মূল ভরসা, তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই।
ট্যাক্সিচালকদের এই বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে ট্যাক্সিচালকেরা এখন দুপুরে খেতে যাওয়া, সন্ধ্যায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার অজুহাতে যাত্রী প্রত্যাখ্যান করছে।” পুলিশ বলছে, আগে তিন হাজার টাকা জরিমানার ভয়ে যাত্রী প্রত্যাখানে লাগাম টানা গিয়েছিল। এখন সেটাও নেই। এক ট্রাফিককর্তা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী জরিমানা কমাতে কেস দিতে না করেছেন। অথচ কোনও সরকারি ঘোষণা হয়নি। তা হলে পুলিশ কেস দিচ্ছে না কেন? ওই পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশেরও পরেও জরিমানা করবে, এমন সাহস কার আছে!”
কী বলছেন ট্যাক্সি সংগঠনগুলি?
বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিমল গুহ বলেন, “প্রত্যাখান করলে চালকের লাইসেন্স সাময়িক ভাবে কেড়ে নেওয়া হবে, এমন আইন দরকার।” সিটুর ট্যাক্সি সংগঠনের নেতা প্রমোদ ঝা বলছেন, “মুষ্টিমেয় কয়েক জন চালক প্রত্যাখান করেন। বদনাম হয় সবার।” তৃণমূলপন্থী ট্যাক্সি সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স ইউনিয়নের নেতা শম্ভুনাথ দে বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী ট্যাক্সিচালকদের যে সুবিধা দিয়েছেন, তার অপব্যবহার করলে প্রশাসন ফের কড়া হতে বাধ্য হবে।”
বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy