নিঝুম: বৌবাজার বিপর্যয় আগেই কেড়েছে গয়নাপাড়ার ঝলকানি। সেই বিপদের দোসর লকডাউনে বন্ধ হয়ে পড়ে বহু দোকান। কোথাও দোকান খোলা থাকলেও নেই ক্রেতা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
প্রতিদিন দু’বেলা নিয়ম করে সেকরাপাড়া, দুর্গা পিতুরি লেন ঘুরে মেট্রোর কাজ কত দূর এগোল, দেখে আসেন তিনি। এর পরে ভাড়ার ঘরে পুজো দিয়ে শুরু হয় বরাতের অপেক্ষা। গত এক বছরের সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বৌবাজারের সোনার কারিগর, বছর বাহান্নর বিজয় সূর্যবংশী বলছেন, “সব জায়গায় লকডাউন হয়েছে গত পাঁচ মাসে। আর এখানে তা চলছে এক বছর ধরে।’’
বৌবাজারের সোনাপট্টি জুড়ে এখন এমনই সুর প্রায় সকলের। তার মধ্যেই মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে বাড়ি ধসে পড়ার স্মৃতি যেন কোথাও করোনার আতঙ্ককেও ছাপিয়ে যায়। গত বছর ৩১ অগস্টই বৌবাজারে ধস নেমে গৃহহীন ও কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন বহু মানুষ। এক বছর পরেও অবস্থা ফেরেনি তাঁদের।
বিজয়বাবু জানাচ্ছেন, ১৯৮২ সালে বাবার হাত ধরে প্রথম সোনাপট্টিতে আসা তাঁর। আদতে মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা, তাঁর বাবা নিউরোত্তিকাকা সূর্যবংশী তত দিনে সেকরাপাড়ায় দোকান করেছেন। ৩০ বছরের ব্যবসায় ধাক্কা দিয়েছে ৩১ অগস্টের সেই দিন। বিজয়বাবু বলেন, “সে দিন হঠাৎ দোকানের আগের একটি বাড়ি ধসে পড়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। পরে দেখলাম, মেট্রোর কাজের জন্য হচ্ছে।’’ দু’দিনের মধ্যেই বিজয়বাবুদের দোকান ফাঁকা করে দিতে হয়। এক মাস পরে জিনিসপত্র বার করার সুযোগ পান। মেট্রো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নতুন দোকান পেতে আরও কয়েক মাস। বিজয়বাবু বলেন, “নতুন ঘর তো পেয়েছি। কিন্তু গত ছ’মাস ভাড়া পাই না। একে অর্ডার নেই, তার উপরে নিজে ভাড়া দিয়ে, লোক রেখে আর কাজ করাতে পারি না।”
একই অবস্থা সেখানকার আর এক সোনার কারিগর শ্যামাপদ ঘোষের। বছর ষাটেকের শ্যামাপদবাবুর দাবি, “বর্ধমান থেকে এখানে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। দোকানেই থাকতাম। রাতারাতি ভিটেছাড়া হয়েছি আমরা।” শুধু কারিগরেরা নন, অন্তত তিন-চারটি দোকান ভাঙা পড়ায় সমস্যায় পড়েছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও। কয়েকটি দোকান আবার মেট্রোর যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়ার পথ করতে ভেঙে ফেলতে হয় বলে অভিযোগ। এমনই একটি দোকানের মালিক সত্যজিৎ রায় দাবি করলেন, তাঁদের দুর্গা পিতুরি লেনের দোকানটি সেই বাড়ি ভাঙার সময় থেকে বন্ধ। পরে মেট্রোর যন্ত্র নিয়ে যেতে ভেঙে ফেলা হয় তাঁদের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের অন্য দোকানটিও। সত্যজিতের কথায়, “দুটো দোকান হারিয়ে অনেক লড়াই করে মেট্রোর থেকে একটা দোকান পেয়েছি। কিন্তু খুব ছোট সেই দোকানে কাজ উতরোনো যাচ্ছে না। বৌবাজারকে প্রায় শেষ করে দিল এই দুই বিপর্যয়।” আর এক দোকানের মালিক তাপস কর আবার বললেন, “করোনা তো এখন হল, গত এক বছর ধরেই বৌবাজার নিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে। জেলার বহু পুরনো ক্রেতা ধরেই নিয়েছিলেন, এখানে সব ভেঙে গিয়েছে। আর এখন তো ট্রেন বন্ধ। অবস্থা ফেরাতে বেশ কয়েকটি ৩১ অগস্ট পেরোতে হবে।”
বৌবাজার স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে যদিও বললেন, “সোনার দাম খুব ওঠানামা করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত কিছুই হবে না। মানুষ সোনা কেন, কিছুতেই বিনিয়োগ করার জন্য পা বাড়াতে পারছেন না। বাড়ি ভাঙার ঘটনা বৌবাজারের বিপদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।”
সেকরাপাড়া লেনেই দেখা মিলল শ্যামসুন্দর দাস নামে এক বৃদ্ধের। বাড়ি আমহার্স্ট স্ট্রিটে। আগে সোনার কারিগর হিসেবে কাজ করতেন, এখন রোজ যান মেট্রোকর্মীদের সাহায্য করতে। কখনও জল এগিয়ে দেন, কখনও বৃষ্টি এলে ছাতা ধরেন। রোজ আসেন? বৃদ্ধ বললেন, “কার দোষ, কার গুণ দেখে লাভ নেই। এখন কাজ করার সময়। সবাই মিলে ভাঙা পাড়াটা মেরামত করে নিতে হবে।’’
কবে পুরনো ছন্দে ফিরবে বৌবাজার? বিপর্যয়ের এক বছর পূর্তির দিনেও সেই উত্তর নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy