Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Garanhatta Street

মুকুট, মানতাসায় দুর্গাকে সাজায় গরানহাটা

মেঘলা বিকেলে গলি জুড়ে সোনালি আভা। গলির মাথায় আলোর চাঁদোয়া, রং-বেরঙের গ্যাসবেলুন। দোকানে থরে থরে সাজানো মুকুট, চাঁদমালা, নেকলেস, মানতাসা।

গরানহাটা স্ট্রিটে গয়নার দোকানে চলছে কেনাকাটা।

গরানহাটা স্ট্রিটে গয়নার দোকানে চলছে কেনাকাটা। নিজস্ব চিত্র।

শ্রেয়া ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৭
Share: Save:

—ছোট কানপাশা আছে?

সরু গলির দু’পাশে সার দিয়ে দোকান। তারই একটির সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন শশব্যস্ত তরুণ।

—কার জন্য লাগবে?

—বাড়ির গোপালের জন্য। পুজো আসছে, মা সাজাবেন।

কার জন্য লাগবে, এই প্রশ্নটা জরুরি ছিল। কারণ, আত্মজা থেকে দশভুজা, যত্নে সাজিয়ে তুলতে চাওয়া বাঙালির সাধ আর সাধ্য এসে মিশে যায় এই গলিতে। এ বছর তার মধ্যেই জেগে উঠছে আহত বাৎসল্যের ঢেউও। অসংখ্য মানুষের ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠা নিহত ডাক্তার-ছাত্রীর জন্য।

রবীন্দ্র সরণির বাঁ পাশের ফুটপাত থেকে শুরু হওয়া গরানহাটা স্ট্রিটে পাওয়া যায় দুর্গার জন্য তামা, পেতলের গয়না। কুমোরটুলির বহু প্রতিমা তাতেই সেজে ওঠে। মেলে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী-সহ বাকি প্রতিমার সাজও। মাথার মুকুট, হাতের রতনচূড়, মেশিনে কাটিং চেন থেকে শুরু করে যাবতীয় গয়নাও পাওয়া যায়। প্রস্তুতি থেকে বিকিকিনি, সবেতেই থাকে বিশেষ যত্ন। দোকানিদের কথায়, ‘‘ঘরের মেয়েকে সাজাব, এটুকু তো করতেই হবে।’’ আর জি কর-কাণ্ডের আবহে মেয়েকে সাজানোর এই ইচ্ছেটুকু আলোর মতো জ্বলতে থাকে।

মেঘলা বিকেলে গলি জুড়ে সোনালি আভা। গলির মাথায় আলোর চাঁদোয়া, রং-বেরঙের গ্যাসবেলুন। দোকানে থরে থরে সাজানো মুকুট, চাঁদমালা, নেকলেস, মানতাসা। গয়নার দোকানের মাঝখানে উঁকি মারে অন্য কাটাই ও ঠোকাইয়ের দোকানও। “তামা-সহ বিভিন্ন ধাতুর পাতে ছাপ তোলার পদ্ধতিকে বলে ঠোকাই। তা দিয়ে বিভিন্ন গয়না তৈরি হয়। আর কোনও ডাইসের মধ্যে ধাতুর পাত প্রবেশ করিয়ে, চাপ দিয়ে কেটে যে ছাঁচ তৈরি হয়, তাকে বলে কাটাই।”— বললেন স্বরূপ বসাক। তাঁর চার পুরুষের ব্যবসা শুরু হয়েছিল কাটাই ও ঠোকাইয়ের কাজ দিয়েই। জানা গেল, এই গয়না মূলত তৈরি হয় তামা দিয়ে। তার উপরে গোল্ড প্লেটিং করা হয়। আগে বিয়ের কনের জন্য এমন গয়না বেছে নিতেন অনেকে। তবে সাত-আট বছর ধরে প্রতিমার গয়না বিক্রির রমরমাও বেড়েছে। ক্রেতারা পছন্দের নকশা এনে প্রতিমার জন্য অলঙ্কার গড়িয়েও নিচ্ছেন। তবে রক্তমাংসের মেয়েদের জন্য অলঙ্কার এখনও মেলে এখানে।

কেন বেড়েছে প্রতিমার অলঙ্কারের রমরমা? স্বরূপ বললেন, “আগে এই গয়না রাজ্যের বাইরে থেকে আসত। তা বাঙালি ধাঁচের গয়না হত না। এখন বাঙালি কারিগরের তৈরি গয়না মানুষ বেশি পছন্দ করছে।” কারিগরেরা কি কলকাতার? স্বরূপের কথায়, “বেশির ভাগই মেদিনীপুরের। তবে আরামবাগ, বারাসত, ডোমজুড় থেকেও রয়েছেন।”

ইতিহাসবিদ ও ক্ষেত্র সমীক্ষক তারাপদ সাঁতরা বলেন, ‘‘গরানহাটা এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিন্তু বহুধাবিস্তৃত।’’ তাঁর লেখাতেই জানা যায়, এক সময়ে নদীপথে সুন্দরবন থেকে আসত গরান গাছের লালচে রঙের মজবুত কাঠ, যা স্বল্পবিত্তদের ঘরের ছিটেবেড়ার দেওয়াল নির্মাণে ব্যবহৃত হত। ফলে একটি হাট ও আড়ত গড়ে ওঠে। প্রাচীন সেই গরানহাটা নামটি আজও রয়েছে। বটতলার বই যাকে বলে, সেটির অন্যতম প্রকাশনাস্থল ছিল এই গরানহাটা। এখন সেখানে রুপো ও অন্য ধাতুর অলঙ্কার শিল্পের দোকানই চোখ টানে বেশি। অবশ্য, বর্তমানের গয়না গলির এ দিক-ও দিক থেকে উঁকি মারে পুরনো ইতিহাসও। গলির বাঁকে দেখা যায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জোড়া আটচালা শিবমন্দির।

তবে গত বারের থেকে ব্যবসা কমেছে বলেই জানালেন দোকানি চিত্তরঞ্জন শাসমল। কারণ, যেমন কাঁচামালের দাম বেড়েছে, তেমনই আর জি কর-কাণ্ডের প্রভাবও পড়েছে জনমানসে। একই সুর প্রতিমার মুকুট কিনতে আসা তন্দ্রা ঘোষের। বললেন, ‘‘মেয়েটার কথা ভুলতে পারছি না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Beniatola Durga Puja 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy