এখনও পুরসভার নামের ফলকে পুরনো ‘সরণি’। অন্য পাশে নতুন নামের ‘ধরণী’ লেখা অস্থায়ী ব্যানার। মঙ্গলবার। রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
মঙ্গলবারের শহর ‘ধরণী’ময়। অফিসে-কলেজে-বাসে-মেট্রোয় মুখে মুখে লি রোডের নতুন নাম। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে কথা পড়তে না-পড়তেই বসে গিয়েছে নতুন সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’!
পরিবর্তনের এই ধাক্কায় একটি বিস্মৃত ইতিহাসও কিন্তু উঁকি দিচ্ছে। নামবদলের তোড়ে বিস্মিত অনেকেরই মনে পড়ছে, খাতায়-কলমে লি রোডের নাম কিন্তু তিন দশক আগেই মুছে গিয়েছিল পুরসভার নথি থেকে।
পুরসভার নথি থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৮২ সালেই লি রোডের নাম বদলে ফেলা হয়। নতুন নাম হয়, ‘ও সি গাঙ্গুলি সরণি’! আচার্য জগদীশ চন্দ্র রোড লাগোয়া রাজপথের পুরনো সাইনবোর্ড এখনও সেই সাক্ষ্য বহন করছে। যেখানে এ দিন সদ্য নতুন সাইনবোর্ড বসেছে। তাতে ধরা পড়েছে, সরণির ‘ধরণী’তে রূপান্তর।
নামবদলের কথা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দেওয়ার এক দিন বাদেও তাই পুরকর্তা থেকে শুরু করে অনেকের মধ্যেই কিছুটা সংশয় কাজ করছে। সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়ও বলছিলেন, ‘‘লি রোডের নাম কিন্তু আগেই বদলে দিয়ে ও সি গাঙ্গুলি সরণি রাখা হয়েছিল।’’ সেই সঙ্গেও তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘পুরনো রাস্তার নাম বদল আমার খুব একটা ভাল লাগে না। পুরনো নামের সঙ্গে পুরনো ইতিহাস, পুরনো অনুষঙ্গও মুছে যায়। লোকেও পুরনো নামটাই মনে রাখে।’’
ঠিক যেমন লি রোড আজও লোকমুখে এই নামেই পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান হ্যারি লি –এর নামে রাস্তাটি চিহ্নিত ১৮৯০ সালে। খোদ পুরসভার বই, ‘আ হিস্টরি অফ ক্যালকাটাস স্ট্রিট’-এই সেই
তথ্য রয়েছে।
এবং সেই বইটিই বলছে, লি রোডের নাম ‘ও সি গাঙ্গুলি’ সরণি হয়ে যাওয়ার কথাও। কলা ও সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে এই নামকরণ। ১৯৮২ সালে ‘রোড রিনেমিং কমিটি’র সুপারিশেই লি রোডের নাম বদলে এই নামকরণ করা হয়। বইয়ের ৬৪০ পাতায় সবিস্তার লেখা সাবেক লি রোড থেকে নাম বদলে ‘ও সি গাঙ্গুলি সরণি’ হওয়ার ইতিবৃত্ত। ২৩৫/১ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড থেকে রাস্তাটি বের হয়েছে।
সোমবারের নামবদলের আমেজে কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সে-সব যুক্তি মানতে রাজি নন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে সত্যজিৎ রায়ের নামে নাম বদলের নির্দেশ দেওয়ার পরে পুরনো নাম (ও সি গাঙ্গুলি সরণি) ভুলে যাওয়ার অভিযোগটুকুও তিনি আমল দিচ্ছেন না। জোর গলায় বলছেন, ‘‘মনে রাখার অত অবকাশ আমার নেই।’’
মেয়র শোভনবাবুর কথায়, ‘‘শহরের রাস্তার নামকরণের একটা প্রক্রিয়া আছে। রোড রিনেমিং কমিটি, মেয়র পারিষদেরা মিলে নতুন নামে সম্মত হলে, সিইএসসি, ডাক বিভাগ— সবাইকে জানাতে হয়।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘লি রোডের নাম বদলে ‘ও সি গাঙ্গুলি সরণি’ করার পর্বে নির্ঘাত কিছু পদ্ধতিগত
ত্রুটি থেকে গিয়েছিল।’’
তা হলে ‘ওসি গাঙ্গুলি সরণি’-লেখা পুরসভার সাইনবোর্ড ওই পথে জ্বলজ্বল করে কী করে? এ প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি মেয়রের কাছে। নামবদল বিতর্ক একফোঁটা গায়ে না-মেখে মেয়র বরং বলছেন, ‘‘আমরা কাউকে ছোট করছি না। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির নামে নামকরণ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে না।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে এ রাজ্যে অবশ্য নাম বদলের হিড়িক লেগেই আছে। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন, মনীষীদের মেট্রো স্টেশন সমূহের ঢালাও নামবদল থেকে শুরু করে নামকরণের অভিনবত্বে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মেট্রো স্টেশনগুলির নামাঙ্করণে একগুচ্ছ মনীষী-স্মরণের দরুণ শহরের ওই এলাকাগুলির প্রকৃত নাম গুলিয়ে যেতে পারে বলেও তখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ফলে, মমতা রেলমন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়ার পরে স্টেশনের নামের মধ্যেও এলাকাগুলির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ শহরেও মমতার দেওয়া নাম এখন মিশে রয়েছে বহু সৌধেই। একটি সাম্প্রতিক নমুনা, আনকোরা পরমা আইল্যান্ড উড়ালপুলের তিনি নাম রাখেন ‘মা’। বাঙালি ছেলেমেয়েদের জন্য
সম্ভাব্য নামের তালিকা-সংবলিত অভিনব ‘নামাঞ্জলি’ বইটিরও মুখ্যমন্ত্রী প্রণেতা।
তা বলে রাস্তার নাম ‘ধরণী’ কেন? এ জল্পনায় দিনভর বাঙালির রসিকতায় জমজমাট সোশ্যাল মিডিয়াও। পুরসভার এক পদস্থ কর্তাই হেসে বলছেন, ‘‘জবরদস্ত নাম! ‘সরণি’র ‘ধরণী’ হওয়া নিয়ে যা বকবক চলছে, তাতে কিন্তু এই নতুন নামটি কেউ সহজে ভুলতে পারবেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy