—প্রতীকী ছবি
পাঁচশো বর্গফুটের একটি নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাট বিক্রি করা হবে বলে টাকা নেওয়া হয়েছিল পাঁচ জনের কাছ থেকে। সাত-আটশো বর্গফুটের ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কোনওটির দাবিদার আট জন, কোনওটির ১০ জন! বহুতলটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে এক-একটি ফ্ল্যাটের দাবিদার কমার নাম তো নেই-ই, বরং আরও বাড়ে!
বছরের পর বছর কাটে, আনন্দপুরের গুলশন কলোনির বি/২৩ জমির বহুতল ঘিরে বিবাদ বন্ধ হয় না। কখনও তা নিয়ে গুলি চলে, কখনও এলাকায় কার্যত ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়। বেশ কয়েক দিন আগে আবার দু’পক্ষের সংঘর্ষে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় পার্ক সার্কাস মোড়। রাজনীতির কারবারিদের প্রচ্ছন্ন মদতেরও অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। সেই হামলার কালো তালিকা আরও বেড়েছে শুক্রবার বিকেলে ওই বাড়ি ঘিরে আনন্দপুরে গুলি চলার ঘটনায়। আহত হয়েছেন দু’জন। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দু’জনেরই অবস্থা সঙ্কটজনক বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। পুলিশ অবশ্য গুলি চলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছিল। শনিবারও অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে আসাদুল হুসেন ওরফে বাংলা রাজু এবং স্বপন মণ্ডল নামে আরও দু’জনকে। তবে এই গ্রেফতারিতে ওই এলাকার দুই দুষ্কৃতী গোষ্ঠীর পুরনো লড়াই কি আদৌ থামবে? প্রশ্নটা অবশ্য থেকেই যায়।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বহুতল ঘিরে গণ্ডগোলের মূল দুই চরিত্রের নাম জুলকর এবং মিনি ফিরোজ। দু’জনেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বাহুবলে বলীয়ান। ২০১০ সালে বি/২৩ ঠিকানায় ওই বহুতল তৈরির কাজ প্রথমে শুরু করে জুলকর। একাধিক প্রোমোটারকে নিয়ে কাজ করা জুলকরই ওই জমি দেখিয়ে প্রায় ৬০ জনের থেকে কয়েক লক্ষ টাকা করে তোলে। কিন্তু নির্মাণ শুরু হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই বহুতলের কাজ থমকে যায়। এক-একটি ফ্ল্যাটের জন্য অন্তত পাঁচ জন করে দাবিদার ওই এলাকায় ভিড় জমাতে শুরু করেন। সেই সময়ে এ নিয়ে রাজ্যের এক মন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ জমা পড়ে। যদিও টাকা যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁদের অভিযোগ, সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি। এর মধ্যেই এক দিন পার্ক সার্কাসে রাস্তা আটকে দুষ্কৃতী তাণ্ডব চরম আকার নেয়। পুলিশি তল্লাশির মুখে ফেরার হয়ে যায় জুলকর। পুলিশ সূত্রেরই দাবি, সে লখনউয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু কলকাতা পুলিশের কোনও দলই তাকে ধরতে পারেনি।
কয়েক বছর পরে ২০১৫ সালে ওই বহুতলের কাজ শেষ করার দায়িত্ব নেয় মিনি ফিরোজ। জুলকরের অনুপস্থিতিতে তত দিনে ওই এলাকায় সে-ই সর্বেসর্বা। মিনি ফিরোজের মধ্যস্থতাতেই ফ্ল্যাটের জন্য যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁরাও নিজেদের মধ্যে হিসেব মিটিয়ে নেবেন বলে জানান। ঠিক হয়, ফ্ল্যাটের দাম কম করে নেওয়া হবে। বদলে যিনি ফ্ল্যাট নেবেন, তিনি অন্য ন্যায্য দাবিদারকে টাকা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু ২০১৯ সালে ওই ঠিকানায় বহুতল নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পরে দেখা যায়, বিবাদ মেটেনি। টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ করে এক-একটি ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তি দাবি করতে থাকেন। সেই থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ওই বহুতলটি। পুলিশ সূত্রের দাবি, এর মধ্যে ২০১৯ সালে কলকাতায় ফেরে জুলকার। ফিরেই সে মিনি ফিরোজের সঙ্গে বিবাদে জড়ায়। জুলকর দাবি করে, ওই বহুতলের জমি তার। সে-ই ফ্ল্যাটগুলো বিক্রির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এ দিকে মিনি ফিরোজও বহুতল ছাড়তে নারাজ। শুক্রবার বিকেলে পরিকল্পিত ভাবে ওই বহুতলের দখল নিতে দলবল পাঠায় জুলকর।
লালবাজার সূত্রের দাবি, জুলকরের ছেলেরা যে বহুতলের দখল নিতে আসবে, সেই খবর ছিল মিনি ফিরোজের কাছে। প্রথমে ওই বহুতলের ছাদ থেকে কাচের বোতল ছোড়া শুরু করে মিনি ফিরোজের ছেলেরা। এর পরে শুরু হয় ইট-বৃষ্টি। হামলার মুখে জুলকরের ছেলেরা গুলি ছুড়তে শুরু করলে পাল্টা গুলি চালায় মিনি ফিরোজের ছেলেরাও। স্থানীয়দের তোলা ওই সংঘর্ষের কয়েকটি ফুটেজে পুলিশ দেখেছে, বহুতলের ছাদ থেকে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছে একদল যুবক। নীচ থেকে পাল্টা গুলি চালাচ্ছে অন্যেরা। মুহূর্তে ওই এলাকা ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে যায়। দ্রুত তালা পড়ে যায় দোকানে-বাড়িতে। যা সিনেমার দৃশ্যের থেকে কোনও অংশে কম নয়।
কিন্তু এত কিছুর পরেও জুলকর বা মিনি ফিরোজেরা গ্রেফতার হয় না কেন?
লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, “গত কয়েক বছরে এরা অনেকটাই ঠান্ডা। যাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় এরা দাপিয়ে বেড়াত, তাঁদের জায়গাও অনেকটা নড়বড়ে। পেশাদার শুটার নিয়ে কাজ করা এই দলকে এ বার দ্রুত ধরা হবে। সবার আগে ওদের রাজ্য ছাড়ার ব্যাপারটা আটকাতে হবে।” এত দিনেও আটকানো যায়নি কেন? পূর্ব কলকাতার এই সন্ত্রাসে কবে যবনিকা পড়বে, সেই প্রশ্নের মতোই উত্তর মেলে না এই প্রশ্নেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy