মহানগরের এক পাশে তৈরি হয়ে উঠছিল একটা নতুন শহর। নামই তার ‘নতুন শহর’, ‘নিউ টাউন’। চোখের সামনে মাটি বালি ফুঁড়ে, চাষজমি জলকাদা সরিয়ে মাথা তুলছিল সুউচ্চ বহুতল, গ্রামগন্ধ সরাতে চাইছিল প্রাণপণে সর্বাঙ্গ থেকে। এক অদ্ভুত টানাপড়েন চলছিল যেন পুরনো আর নতুনের মধ্যে: শহর-গ্রাম, আধুনিকতা-প্রাচীনতা যেন দাঁড়িয়ে ছিল মুখোমুখি, টান-টান উত্তেজনায়। ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফার তো চাইবেনই এমন এক ‘সংঘর্ষ’কে ক্যামেরায় ধরে রাখতে, ইতিহাসেরই দাবি মেনে। সেই কাজেই লেগে পড়েছিলেন রাজীব দে, ২০১০ সাল থেকে। নিজে সল্ট লেকের বাসিন্দা, গত অর্ধশতক জুড়ে যে উপনগরী হয়ে উঠেছে ‘নতুন কলকাতা’র অন্যতম অভিজ্ঞান। সেই ভাবনা থেকেই নিউ টাউনের গড়ে ওঠাকেও ক্যামেরাবন্দি করে রাখার ইচ্ছে পুরুষ্টু হয়।
তারই মধ্যে ঘটল একটা ঘটনা। ২০১৩-র এক দিন, বাসে ফেরার সময় চোখ গেল সহযাত্রীর ফোনের পর্দায়। কোন এক প্রাচীন শহরের প্রত্নাবশেষ সেখানে, অতিকায় প্রলম্বিত ছায়া ফেলেছে। আর বাস তখন যাচ্ছে নিউ টাউন দিয়ে, বিকেলের হলদে আলোয় দেখা যাচ্ছে দূরের দিগন্তে শ্বাস ফেলছে উঁচু উঁচু হাইরাইজ়। অদ্ভুত অনুভূতি: পর্দায় এক প্রাচীন শহরের দীর্ঘশ্বাস, আর বাস্তবে এক নবীনের উচ্চাশা। জানা গেল, প্রাচীন শহরটি হাম্পি, তুঙ্গভদ্রা তথা পম্পার জল আর চার পাশের পাহাড়ের বেষ্টন প্রাচীন বিজয়নগর সভ্যতার যে শহরকে সুরক্ষিত রেখেছিল অতীতে। আলোকচিত্রীর উৎসাহ রাজীবকে টেনে নিয়ে গেছে হাম্পিতে, এই ক’বছরে অন্তত আট বার!
এই নিরন্তর যাতায়াতের ফসল ভরে উঠছিল ঘরে— হাসেলব্লাড অ্যানালগ ক্যামেরায় প্যানোরামা আঙ্গিকে তোলা সাদা-কালো কয়েক হাজার ছবি: এক দিকে হাম্পি, অন্য দিকে নিউ টাউনের। অলক্ষেই যেন তৈরি হয়ে উঠল অঘোষিত এক প্রকল্প। ইতিহাস-বইয়ে থাকা আর ইতিহাস হয়ে-ওঠা দুই শহরের ডকুমেন্টেশন যেন, সেতু এই ছবিগুলি। আর কে না জানে, ছবিতে যা দেখা যায়, ছবি বলে তারও বেশি! কয়েক হাজার ছবির মধ্য থেকে ১১৮টি ছবি বেছে নতুন একটি বই নির্মাণ করেছেন রাজীব দে, টেল অব টু সিটিজ়: হাম্পি/ নিউ টাউন (প্রকা: ব্লু ট্রি)। তার ছোট্ট অথচ ভাবনা-জাগানিয়া ভূমিকায় কল্যাণ রায় লিখেছেন স্মৃতি ও ইতিহাসের অনন্ত চলাচলের কথা, অস্তিত্ব ও পরিবর্তনশীলতার প্রসঙ্গ।
ছবিগুলি জোড়ায় জোড়ায় সাজানো, কোনগুলো হাম্পির আর কোনগুলো নিউ টাউনের আলাদা করে বলে দেওয়া নেই; লেখা নেই সাল-তারিখ, শাটার পড়ার দিনক্ষণ। এ এক রকম ইচ্ছে করেই। আলোকচিত্রী চান যেন দর্শকের মনে দুই শহরের ছবি ‘দেখা’র বাইরেও অন্য এক ‘দর্শন’ উস্কে দেয়: বহতা সময় নিয়ে যেমন, তেমনই নগরায়ণ, উন্নয়ন ইত্যাদি ধারণা নিয়েও। পাহাড়ি জমি, বোল্ডারের স্তূপ, ভাঙা দুর্গ-দেওয়াল, তোরণ, মন্দির এক দিকে, অন্য দিকে উড়ালপুল, হর্ম্যরাজি, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আধুনিক দেওয়াল-অলঙ্করণ... চেতনায় সব মিলেমিশে যায়। অলস সময় কাটানো পশুপাখি আর মানুষের উপস্থিতি দুই ছবিতেই, তবু কত আলাদা— এক ছবিতে তারা ফেলে আসা সময়ের প্রত্নজীব, অন্য ছবিতে সমাগত অনাগত কালের বার্তাবহ। তেমনই দু’টি ছবি এখানে।

অন্য রকম
বইমেলায় বই ঘিরে আলোচনা ও প্রদর্শনী তো হবেই। তবে এ বছর খাস বইমেলা প্রাঙ্গণে নজর কাড়ছে অনন্য এক প্রদর্শনী, যার বিষয় বাংলায় মুদ্রণশিল্পে খোদাইচিত্রের শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড ও আর্ট অলিন্দ-র যৌথ ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত হচ্ছে এই প্রদর্শনী, থিম প্যাভিলিয়ন আর ফুড কোর্টের পাশে আলাদা স্টলে, জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের উপস্থাপনায়। প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রের মডেল, কাঠের ব্লক, খোদাইচিত্রের যন্ত্র ইত্যাদির নমুনা ছাড়াও প্রদর্শিত হবে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ছাপা বইপত্র ও সখা (ছবিতে ১৮৮৬-র অলঙ্করণ), মুকুল, শিল্প পুষ্পাঞ্জলি ইত্যাদির প্রাচীন প্রকাশনার নিদর্শন। ঠাকুরমার ঝুলি-র দুষ্প্রাপ্য দ্বিতীয় সংস্করণও দেখা যাবে। কর্মশালায় থাকবেন কাঠখোদাই শিল্পীরা, হবে কাগজ তৈরির কর্মশালাও; গ্রন্থ চিত্রণের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবেন শিল্পী ও শিল্প-গবেষকরা। ছোটদের গল্প শোনাবেন আজকের দাদু-দিদারা।
ক্যামেরা-চোখে
একটা দেশ যুদ্ধ নিয়ে বেঁচে থাকে, মরে, ফের বেঁচে উঠতে যুদ্ধ শুরু করে— এক খণ্ড নরম তুলতুলে রুটির জন্য। দেশকল্যাণ চৌধুরীর জন্ম-কর্ম কলকাতায়, ছবি-সাংবাদিকতার সূত্রে ২০০২ ও ২০১০-এ আফগানিস্তানের আগাপাছতলা ঘুরে দেখেছেন, লেন্সবন্দি করেছেন। তারই কিছু বাছাই ছবি নিয়ে প্রদর্শনী ‘আফগানিস্তান: আ স্টোরি অব ব্রেড অ্যান্ড ব্যাটল’, কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আর্টস, লিটরেচার অ্যান্ড কালচার-এ। উঠে এসেছে কাবুল, বাগরাম, পানশির উপত্যকা, তারিন কোট, উরুজগান প্রদেশ, কন্দহর, বামিয়ানের ছবি; আফগান জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম। ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টায় উদ্বোধন করবেন খান আব্দুল গফফর খানের প্রপৌত্রী ইয়াসমিন নিগার খান। ৮ তারিখ পর্যন্ত, দুপুর ১টা-সন্ধে সাড়ে ৭টা।
ফিরে এল
বাংলা ভাষায় লেখা অপরাধ-সাহিত্য নিয়ে একটা আলাদা আকর্ষণ আজকাল চোখে পড়ে পাঠকমহলে। তবে বহু আখ্যানেরই ঘোরাফেরা অবাস্তবের ভূমিতে। সুপ্রতিম সরকারের জনপ্রিয় ‘গোয়েন্দাপীঠ’ সিরিজ় তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, এই শহর ও সময়ের জীবন-বাস্তবতায় তার গভীর শিকড়। এই সিরিজ়েরই নতুন বই ফিরে এল গোয়েন্দাপীঠ (প্রকা: আনন্দ)— আটটি চাঞ্চল্যকর মামলার থ্রিলারধর্মী উপস্থাপনায় বাস্তবের গোয়েন্দাদের তদন্তপথের নানা চড়াই-উতরাই, টানাপড়েনের আখ্যান। আছে সিরিয়াল-কিলার চেনম্যানের অপরাধ-বৃত্তান্ত, সাম্প্রতিক অতীতে জয়নগরে নাবালিকার ধর্ষণ ও খুনের মামলার তদন্ত-পদ্ধতির অনুপুঙ্খ। তদন্ত শিক্ষার্থী থেকে রহস্যপিপাসু পাঠক, কাজে দেবে উভয়েরই।
নব্বই পেরিয়ে
আত্মপ্রকাশ লন্ডনে, ১৯২১-এ। ‘পি ই এন ইন্টারন্যাশনাল’ (চলতি কথায়, পেন)-এর বঙ্গ-শাখার যাত্রা শুরু ১৯৩৪-এ। কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সম্পাদকদের মঞ্চ হিসাবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে চলেছে সংগঠনটি। প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মণীন্দ্রলাল বসু; বিভিন্ন সময়ে পেন ওয়েস্টবেঙ্গল-এর সভাপতির দায়িত্বভার সামলেছেন অন্নদাশঙ্কর রায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নবনীতা দেব সেন প্রমুখ, এই মুহূর্তে সভাপতি সুবোধ সরকার। ৯১তম প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে গত ২৯ জানুয়ারি বাংলা আকাদেমি সভাঘরে হল অনুষ্ঠান; সাহিত্য পুরস্কার প্রদান, বই প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গ-শাখার নতুন কমিটিও তৈরি হয়েছে। আর ছিল কবিতাপাঠের আসর।
একই অঙ্গে
বিশ্ব সঙ্গীতের আসর ‘সুর জাহাঁ’ আবারও শহরে। ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি, গল্ফ গ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে মূল মঞ্চে অনুষ্ঠান, আজ ও আগামী কাল সকালে শিল্পীদের সঙ্গে কর্মশালাও। এই বছর থাকছে নেদারল্যান্ডসের ফোককর্ন, সুইডেনের অ্যাল মোলের ট্রায়ো, আইসল্যান্ডের আমব্রা অঁসম্বল, তাঁদের সঙ্গী হবেন রাজস্থানের মরুসুর নিয়ে আসা কসম খান লাঙ্গার দল, বাংলার বাউল, সুরবন্ধন-এর পরিবেশনা ‘গান স্যালুট টু সলিল চৌধুরী’ এবং কলকাতার দীপময় দাসের নেতৃত্বে লোকগানের দল। থাকছে ওড়িশার কোরাপুট অঞ্চলের দুড়ুয়া জনজাতিদের নাচ-গান, আর রাজস্থানের অ্যাপ্লিকের কাজ, মহারাষ্ট্রের ওয়রলি চিত্রকলা, ওড়িশার কোটপাড় বয়নশিল্প, নানুরের কাঁথাশিল্পীদের কাজ। একই অঙ্গে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক।

আজও চমৎকার
উপনিবেশবাদ বহুকাল পিছনে ফেলে এলেও, উপনিবেশের ইতিহাসের ছোঁয়াটুকু আজও পাওয়া যায় ডালহৌসিপাড়ার স্থাপত্যে, অলঙ্করণ-ভাস্কর্যে। সে কালের প্রশাসনিক হম্বিতম্বির কেন্দ্র ছিল এই এলাকা, আজও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে রাইটার্স বিল্ডিং, জিপিও, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ-সহ আরও বহু স্থাপত্য-নিদর্শন। চার্চ লেনে ছিল বাবার কাজের জায়গা, সেই সূত্রে এ পাড়া অগণিত বার ঘুরেছেন আলোকচিত্রী বিজয় চৌধুরী, ক্যামেরাবন্দি করেছেন দারভাঙার মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিংহের মূর্তি, হাই কোর্ট-পাড়ার নিয়ো-গথিক শৈলীর বিরাট জানালা, লাল দিঘি, মেটকাফ হল, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে গ্রীষ্মদুপুরে ক্লান্ত মানুষের ঘুম, সেন্ট জন’স চার্চে রোহিলা যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, আরও কত কী। সেই সব ছবি দিয়েই করেছেন নতুন ইংরেজি বছরের চমৎকার টেবিল ক্যালেন্ডার। ছবিতে তারই একটি, স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইনশিয়োরেন্স বিল্ডিংয়ের গায়ে চোখ-জুড়ানো মূর্তি ও অলঙ্করণের নমুনা।

দশ নক্ষত্র
সুকুমারী, নীহারবালা (ছবি), সুশীলাবালা, কুসুমকুমারী, কৃষ্ণভামিনী, নরীসুন্দরী, নীরদাসুন্দরী, তিনকড়ি, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী। কিছু নাম সুপরিচিত, কিছু নয়। বাংলায় পেশাদার থিয়েটারের গোড়ার দিকের অভিনেত্রী ওঁরা: ভদ্রবিত্ত ঘেরাটোপের বাইরের ‘অশুচি’ পরিসর থেকে, বহু বাধা পেরিয়ে এসে দাপিয়ে কাজ করেছিলেন মঞ্চে। পুরুষশাসিত পরিবেশের কূট চাল, ব্যক্তিপুঁজিনির্ভর খবরদারি সামলে নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন ‘নাম’, সুনাম এনেছিলেন মঞ্চে, সিনেমায়। নিশ্চিত ভাবেই এঁরা বাংলা মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণের পুরোধা। এই মহীয়সীদের প্রতি শ্রদ্ধায় একটি শৌখিন স্কেচ/নোটবুক প্রকাশ করেছে ‘ব্লু ফিশ’, বইমেলায় ঠিকানা ‘লা স্ত্রাদা’। মঞ্জিষ্ঠা ও হরীতকীতে রাঙানো, মলাট হাতে বোনা সুতির কাপড়ের: অনিন্দিতা ঘোষ অলোক সোম গৌড়বিনোদ মিস্ত্রীর কারুকৃতিকে স্নিগ্ধ রূপ দিয়েছেন হার্দিকব্রত বিশ্বাস।
মহাকাব্যে ধর্ম
সাধারণ ভাবে ধর্ম বলতে লোকে যা বোঝে, রামায়ণ বা মহাভারত মতে ধর্ম তা থেকে আলাদা। অনেক সময়েই তা নীতি ও নৈতিকতার ধারণার অঙ্গাঙ্গি। কী সেই ধর্মের প্রকৃতি, তার সঙ্গে ধর্মীয় বিধান বা আচারের সম্পর্কই বা কী, কী ভাবে তা মানুষের আবেগ ও আচরণ প্রভাবিত করে? এমনই বহু প্রশ্ন ও তার উত্তরের এষণা রয়েছে ভারতীয় মহাকাব্যে। সেই অনুসন্ধানগুলিই এ বার দেশ-বিদেশের গবেষক-চিন্তকদের ভাবনাসূত্রে গ্রথিত হবে আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে, ‘ইন্ডিয়ান এপিকস অ্যান্ড দ্য হিউম্যান কন্ডিশন’। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের সেন্টার ফর ইন্ডোলজিক্যাল স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ-এর উদ্যোগে, আগামী ৪ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি। ৪ তারিখ বিকেল ৫টায় উদ্বোধন-অনুষ্ঠান বিবেকানন্দ হল-এ, মূল ভাষণ দেবেন স্বামী তত্ত্বময়ানন্দ ও অধ্যাপক অশোক ভোহরা। পরের দু’দিন সকাল ১০টা থেকে দিনভর শিবানন্দ হল-এ নানা আলোচনা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)