বাঁধভাঙা: জয়ের পরে আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে রাজপথে সমর্থকেরা। রবিবার, বিডন স্ট্রিটের ঢুলিপাড়ায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কলকাতা যদি নীল-সাদা সমুদ্র হয় রবিবার রাতে, শহরের এই তল্লাট ছিল ছোট্ট এক তেরঙা দ্বীপ। জাতীয় পতাকার লাল, সাদা, নীল গায়ে জড়িয়ে যেখানে শেষমেষ হাসি, কান্নায় গলা জড়াজড়ি করে বসে থাকলেন ওঁরা। ফ্রান্সের সাদা, কালো, বাদামি নানা রঙা রংধনু মানুষ…এ পর্যন্ত এবং আরও অনেকটা লিখে ফেলেছিলাম ম্যাচের বিরতির আগেই। ফ্রান্সের এর পরের গোলগুলোয় সেই প্রতিবেদনই যেন ঝড়ে ওলটপালট, তছনছ।
পার্ক স্ট্রিটের একটি নাইট ক্লাবে কলকাতার ফরাসি কনসুলেট ও আলিয়াঁস ফ্রঁসেজ পরিবারের কিছু বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বকাপ ফাইনালদেখার আসর তখন রঙে রঙে ভরপুর। শাল মুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে পিতৃভূমির পতাকা গায়ে জড়ানো ফরাসি যুবক বিভোর হয়ে তাঁর ভারতীয় বান্ধবী, বেহালার তরুণী ডিজ়াইনারের গালে আদরকরছেন। কলকাতায় গল্ফ খেলতে আসা ভারতীয় মালয়ালি বংশোদ্ভূত ফরাসি বিজ্ঞানী বিশ্বজিৎ বড়াকুমুরিকে জড়িয়ে ধরে আলিয়াঁসের ডিরেক্টর নিকোলা ফাসিনো ‘আলে আলে লে ব্ল্যু’ বলে গর্জন করে উঠলেন। বাংলা তর্জমায় এই শব্দবন্ধের অর্থ, চলো, এগোও নীলজার্সিধারীরা। আর্জেন্টিনার প্রিয় লব্জ ‘ভামোস, ভামোস’-এরই ফরাসি প্রত্যুত্তর। ম্যাচ শেষে কিন্তু ফরাসি কনসাল জেনারেল দিদিয়ে তলপ্যাঁ ম্লান হেসে বললেন, “সে লা ভি (এটাই জীবন)! ফুটবলে এক জন হারবেই!” ফরাসি কনসুলেটের কর্মী, কিন্তু আশৈশব ঘোষিতআর্জেন্টিনা সমর্থক জনৈক কলকাতা-কন্যা মজা করে দিদিয়েকে বললেন, “তা হলে কাল আমার চাকরিটা থাকছে তো!” কনসাল জেনারেল ছদ্মগাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন, “সে দেখা যাবে!”
কলকাতায় ফরাসি ফুটবলপ্রেমীদের এই আখড়ায় কিন্তু ঢুকে পড়েছিলেন মেসি পক্ষের অনেকেই। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী সাত সকালে ফরাসিদের কাছ থেকে নেমন্তন্ন পেয়ে আলিয়াঁসের ডিরেক্টর নিকোলা ফাসিনোকে বলেনও, ‘‘দেখো ভাই, আমি কিন্তু ঘোর আর্জেন্টিনা!’’ নিকোলা স্মিত হেসে ‘সবারে করি আহ্বান’ মেজাজে বলেছিলেন, ‘‘তাতে কী,আমরা তো সবাইকে নিয়েই আনন্দ করতে চাই!’’ প্রথমার্ধের ধাক্কা শেষে ফ্রান্স খেলায় ফেরার পরে নিকোলা বলছিলেন, “হাফটাইমেদেশঁ মনে হয় ওদের ইলেকট্রিক শক দিয়েছে!” আর কতিপয় আমন্ত্রিত আর্জেন্টিনা ভক্ত তখন হিসাবকষছেন, পার্টিতে বিয়ার ছেড়ে হুইস্কি খাওয়াই বোধহয় কাল হল! নইলে এমবাপেরা কক্ষণও ম্যাচে ফিরত না। বিবাহসূত্রে ঠাকুরপুকুরেরবাসিন্দা, আর্জেন্টিনার কোরিয়েন্তেসের রোক্সানা ঠাকুর তখনই ‘মেসেজ’ করে বলছেন, এই জন্য ম্যাচশেষের আগে আমি কখনও নাচানাচি করি না!
মহাকাব্যিক উত্থান-পতনের শেষে কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালের বিজিত পক্ষ কলকাতার ফরাসিদেরঅনেকের মুখগুলোই চোখে ভাসছে। ঝরঝরে বাংলা বলেন চিত্রপরিচালক ফ্রাসোঁয়া জোলি। চন্দননগরের নেলিন মণ্ডলের বন্ধুজন। জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে ছবির কাজে ব্যস্ত আছেন। ফ্রান্স একটা গোল শোধ করার পরে বলছিলেন, একটু চুপ করুন, খেলাটা এখন মন দিয়ে দেখতে হবে। টাইব্রেকারেরশেষে থম মেরে বাজ পড়া মুখে বসেছিলেন। শুরুতে দৃপ্ত স্বরে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন ক্যারিবিয়ন বংশোদ্ভূত ফরাসি যুবা উইলিয়ম লোগান। তিনি, আলিয়াঁসের কর্মী তাঁর দুই বান্ধবী জোহানা, আনার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছেন। গোড়ায় ফ্রান্সের বিপর্যয়ের সময়ে প্যারিস থেকে আসা রাফাল বলছিলেন, ‘‘কীকাণ্ড! গ্রিজু পর্যন্ত ডিফেন্স করছে।’’ শেষরক্ষা হয়নি। তবে ডুবতে ডুবতে এমবাপের হ্যাটট্রিকে ভেসে ওঠা মুখগুলোর কান্নাহাসির লুটোপুটি চোখে লেগে থাকল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy