অধ্যবসায়: বাড়িতে অনুশীলনে ব্যস্ত কঙ্কণ মাইতি। নিজস্ব চিত্র
অস্ত্রোপচার করে জিভের অনেকটা অংশ বাদ দিতে হয়েছিল। ফলে বাদ সেধেছিল স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার প্রক্রিয়া। চোখের আঁধারকে জয় করে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা সেই লোকসঙ্গীত শিল্পীর ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাচ্ছিল কার্যত অন্ধকারে। কিন্তু সেই লড়াইয়ে হার না মেনে বিশ্বাসে ভর করে ফের মঞ্চে গান গাইতে শুরু করেছেন তিনি।
পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া বন্দর এলাকার বৈষ্ণবচক গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা কঙ্কণ মাইতি। জন্ম থেকেই তিনি দৃষ্টিহীন। বাবা পান্নালাল মাইতির কথায়, “তিন মাস বয়সে প্রথম ধরা পড়ে চোখের সমস্যা। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ছেলে কোনও দিনই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না।” সেই বাস্তব মেনেও নিয়েছিলেন তাঁরা। গানবাজনায় ছেলের আগ্রহ দেখে পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু হয় সেই চর্চা। ২০১৬ সালের শেষ দিকে জিভে কিছু সমস্যা দেখা দেয় কঙ্কণের। মাস তিনেক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা চালিয়েও না কমায় তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান পরিজনেরা। চিকিৎসকের পরামর্শে কলকাতায় এসে ধরা পড়ে, কঙ্কণের জিভে ক্যানসার। বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পাঁচ জন চিকিৎসকের একটি দল বাদ দেয় কঙ্কণের জিভের অনেকটা অংশ। সঙ্গে সঙ্গে জিভের পুনর্গঠন করেন প্লাস্টিক সার্জন অনুপম গোলাস। তিনি জানান, কঙ্কণ যেহেতু জন্মান্ধ, তাই তাঁর হাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। সে কারণেই হাত থেকে টিসু না নিয়ে, জিভ পুনর্গঠনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল মুখের ভিতরের টিসু। তবে স্বাদকোরক আর ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি।
চিকিৎসকদের বিশ্বাস ছিল, কঙ্কণের যা মনের জোর, তাতে গানের জগতে ফিরে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। দীর্ঘ পরিশ্রম ও অভ্যাসে সেই কাজটাই করেছেন কঙ্কণ। গৌতমবাবুর কথায়, “ক্যানসার এমন একটা অসুখ, যেখানে রোগী এবং তাঁর পরিবারের মনের জোর সব থেকে বেশি প্রয়োজন। এই জায়গাতেই প্রথম থেকে এগিয়ে ছিলেন কঙ্কণ। কলকাতা থেকে বহু দূরে গ্রামে থেকেও হাল না-ছাড়া মনোভাব ওঁর শিল্পীসত্তাকে ফের জাগিয়েছে।” আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি-র বিভাগীয় প্রধান ইন্দ্রনাথ কুন্ডু বলেন, “জিভ বাদ দিয়ে পুনর্গঠন হলেও বহু মানুষই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেন না। কথায় জড়তা থেকে যায়। সেখানে এক জন শিল্পীর ফের গানের জগতে ফেরা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। এটা অসম্ভব নয়, কিন্তু মনের জোর আর অধ্যবসায় দরকার। এমন দৃষ্টান্ত অন্যদেরও উৎসাহিত করবে।”
কঠিন এই লড়াই জিতেও অবশ্য বিষণ্ণ শিল্পী। কারণ, কোনও নির্দিষ্ট রোজগার নেই তাঁর। সরকারের তরফে কী সাহায্য পেতে পারেন, জানা নেই কঙ্কণের। মাস কয়েক ধরে গান শুরু করলেও, সে ভাবে অনুষ্ঠানের ডাক আসে না। গান গাইলে খুব বেশি এক হাজার টাকা পাওয়া যায়। তার মধ্যে কিছু খরচ হয়ে যায় যাতায়াতেই। ডাক্তার দেখাতে তিন-চার মাস অন্তর কলকাতায় আসতে হয়। এর পাশাপাশি রয়েছে সংসারের খরচ।
খানিক হতাশ গলায় কঙ্কণ তাই বলেন, “বাবার বয়স হচ্ছে। ছেলেটাও বড় হচ্ছে। সামনে অনেক খরচ। জানি না, সে সব কী ভাবে সামলাব। গান গাওয়া ছাড়া তো কিছুই জানি না। সেই রোজগারটাই একমাত্র ভরসা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy