ফাইল চিত্র।
ভাড়াটে-অধিকৃত পুরনো, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি নির্মাণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য পুর নির্মাণ-বিধিতে বাড়ির মালিকদের বাড়তি জায়গা দেওয়ার নিয়মে চূড়ান্ত ‘অনিয়ম’ চলছে বলে কলকাতা পুর প্রশাসনের একাংশে কানাঘুষো চলছিল। অভিযোগ, পুর বিল্ডিং আইনের ১৪২ নম্বর ধারায় ভাড়াটের তথ্যে কারচুপির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা চলছে শহর জুড়ে। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পুর প্রশাসনের একাংশও। এ বার সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিলেন কলকাতার বিদায়ী পুর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। বিষয়টি নিয়ে এলাকাভিত্তিক অন্তর্বর্তী তদন্তের পাশাপাশি পুলিশি তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
ফিরহাদের কথায়, ‘‘দেখা যাচ্ছে অ্যাসেসমেন্টের খাতায় ভাড়াটের নাম রয়েছে, কিন্তু ভাড়াটেই নেই সেখানে! অথচ ভাড়াটের নাম করে প্রোমোটার বা বাড়ির মালিক বাড়তি জায়গা পেয়ে যাচ্ছেন। পরে সেই বাড়তি জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছেন।’’ স্বাভাবিক ভাবেই পুর নির্বাচনের তিন দিন আগে এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
পুর প্রশাসনের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, গত কয়েক বছর ধরেই এমন অনিয়ম চলছিল। কিন্তু পূর্বতন পুর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে কেউই তাতে গুরুত্ব দেননি। সেখানে এই ‘অনিয়ম’কে চিহ্নিত করে ফিরহাদ বিষয়টিকে পুর প্রশাসকমণ্ডলীর বৈঠকে তুলেছেন। এবং নির্দিষ্ট নিয়মবিধিও জারি করেছেন। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘পুরসভার কোনও অনিয়ম আসন্ন ভোটের আগে প্রকাশ্যে এলে স্বভাবতই পুর প্রশাসকমণ্ডলীর কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তা জানা সত্ত্বেও ফিরহাদ হাকিমের এই পদক্ষেপকে সাহসী বলতেই হবে।’’
একই সঙ্গে তাঁরা এ-ও বলেছেন, এই অনিয়মের সঙ্গে পুর প্রশাসনের অন্দরের কেউ জড়িত কি না, তা চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার দায়িত্ব বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলী এড়িয়ে যেতে পারে না। অনিয়মের ব্যাখ্যা করে পুরকর্তারা জানাচ্ছেন, পুর বিল্ডিং আইনের ১৪২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভাড়াটে থাকা জীর্ণ বাড়ি ভেঙে তা নির্মাণে রাজি হলে বাড়তি জায়গা পান মালিকেরা। যেমন, কোনও বাড়িতে ভাড়াটে-অধিকৃত অংশ ১০০ বর্গফুট হলে প্রস্তাবিত নতুন বাড়িতে অতিরিক্ত আরও ১০০ বর্গফুট অর্থাৎ, মোট ২০০ বর্গফুট জায়গা পাওয়া যাবে। এলাকাবিশেষে এবং রাস্তার প্রস্থের উপরে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মালিক ওই বাড়তি এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিয়ো) পাবেন। প্রয়োজনে বাড়ির উচ্চতা বাড়িয়ে বাড়তি তল নির্মাণ করতে পারবেন। যেখানে বাড়ির উচ্চতা বাড়ানো সম্ভব নয়, সেখানে প্রস্তাবিত বাড়ির চার পাশে বাড়ানোর অনুমতি মিলবে (অর্থাৎ, বাড়ি নির্মাণে জমির চারপাশে যে জায়গা ছাড়া বাধ্যতামূলক, সেখানে অপেক্ষাকৃত কম জায়গা ছেড়ে বাড়ি করা যাবে)। আসল কথা, ওই অতিরিক্ত ১০০ বর্গফুট বিক্রি করে বাড়ির মালিক আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারবেন।
দেখা যাচ্ছে, এই ছাড়ের সুবিধা নিতে পুরসভায় যে সব আবেদনপত্রের ঢল নেমেছে, তার অনেকই ভুয়ো। যেমন, সংশ্লিষ্ট বাড়িতে ভাড়াটেই নেই। অথচ তাঁদের সইসাবুদ করা লিখিত সম্মতি আবেদনপত্রের সঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে পুরসভায়! আশ্চর্যের বিষয় হল সেই আবেদন অনুমোদনও পাচ্ছে। কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে, তার বিশ্লেষণে বসেই প্রশাসনের কর্তারা বড়সড় দুর্নীতির আঁচ পেয়েছেন। যার সঙ্গে পুরসভার একাংশও জড়িত বলে দাবি তাঁদের।
কারণ, আবেদনে উল্লেখিত ভাড়াটে-তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব পুর বিল্ডিং দফতরের আধিকারিকদের। কত জন ভাড়াটে রয়েছেন বা আদৌ রয়েছেন কি না, কিংবা ভাড়াটে থাকলে তাঁরা কত বছর ধরে রয়েছেন ইত্যাদি তথ্য যাচাই করা হয়। সংশ্লিষ্ট বাড়ি পরিদর্শন করে প্রাপ্ত তথ্য পুর মূল্যায়ন ও কর সংগ্রহ (অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড কালেকশন) দফতরের ‘ইনস্পেকশন বুক’ (আইবি) এবং পুরসভার অ্যাসেসমেন্ট দফতরের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেন আধিকারিকেরা। তেমনই আইবি কপিতে ভাড়াটে তথা সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য ‘আপডেট’ রাখার দায়িত্ব মূল্যায়ন ও কর সংগ্রহ দফতরের।
কিন্তু সেই সর্ষের মধ্যেই ভূত থেকে যাচ্ছে বলে ‘মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং কমিটি’ সূত্রের খবর। যার মুনাফা লুটছেন এক শ্রেণির মালিক ও প্রোমোটারেরা। নিয়ম-নীতির পরিপন্থী এই ঘটনা সম্পর্কে বিল্ডিং কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘ভাড়াটে-অধিকৃত পুরনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরিতে মালিকদের উৎসাহিত করতে পুর বিল্ডিং আইনে ১৪২ ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তার অপব্যবহার হচ্ছে।’’ ‘স্টেট লেভেল বিল্ডিং কমিটি’র এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাস্তবে যদি ভাড়াটেই না থাকে, তা হলে পুরো জায়গাই মালিকের। এখন কলকাতার অনেক জায়গারই বিক্রয়মূল্য বর্গফুট পিছু ৭-১৩ হাজার টাকা। তথ্যে কারচুপি করে কেউ যদি ৩০০ বর্গফুট জায়গাও বিক্রি করেন, তা হলে বর্গফুট পিছু দরের হিসাবে মুনাফা হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা। যে কারণে ১৪২ ধারার সুবিধা পেতে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে।’’ যা কার্যত স্বীকার করেছেন ফিরহাদও। বলছেন, ‘‘আইনের ফাঁককে কাজে লাগিয়ে একটা চক্র সক্রিয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy