কালীপুজোর রাতে লাগাতার চকোলেট বোমার আওয়াজে নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধ। রাতে ঘুম নেই, বুকটা ধড়ফড় করছে। পরের দিন পারিবারিক চিকিৎসক এসে পরীক্ষা করে দেখলেন, বৃদ্ধের রক্তচাপ ১৬৫/১০০। সুস্থ হতে দিন কয়েক ঘরেই শুয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
কালীপুজোয় দেদার আতসবাজি ফাটিয়েছিল বছর দশেকের ঋচীক। পরের দিন থেকেই শুরু হল কাশি, সঙ্গে শ্বাসকষ্টও! বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরীক্ষা করে বললেন, শ্বাসনালীতে মারাত্মক সংক্রমণ হয়েছে। যার উৎস আতসবাজির বিষাক্ত ধোঁয়া।
শব্দবাজির দাপটে কালীপুজোর রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলা। নিজের শরীরের পাশাপাশি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হবে কি না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বুকে ধোঁয়া গেলে
চকোলেট বোমা কিংবা দোদোমার মতো শব্দবাজি প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলে। এ নিয়ে বহু দিন ধরেই লড়াই চলছে বাজি ব্যবসায়ী ও পরিবেশকর্মীদের। পরিবেশবিদেরা এ-ও জানাচ্ছেন, আতসবাজির ধোঁয়াও কম ক্ষতিকর নয়। গন্ধক, লোহাচুর, ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক পোড়ানোর ফলে তৈরি হওয়া ওই সব ধোঁয়ায় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষাক্ত ধোঁয়া ও অতিরিক্ত ভাসমান ধূলিকণা থেকে শ্বাসনালী, ফুসফুসের মারাত্মক রোগ হতে পারে বলেও জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আতসবাজির ধোঁয়া নীরব ঘাতকের মতো।’’
শহরে শব্দবাজি ও আতসবাজির দূষণ ধরা পড়েছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছেও। পর্ষদ সূত্রের খবর, শব্দবাজির জেরে কালীপুজোর শহরের সামগ্রিক শব্দমাত্রা অন্যান্য দিনের তুলনায় ১৩-১৫ ডেসিবেল বেশি থাকে। গত বছর কালীপুজোর রাত ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে সল্টলেক, বেহালায় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে তিন গুণ ছিল। বিটি রোডে সেই মাত্রাটা রাত ১১টায় ছিল স্বাভাবিকের থেকে ১০ গুণ বেশি! ‘‘এর জন্য দায়ী আতসবাজির ধোঁয়া,’’ বলছেন এক পরিবেশবিজ্ঞানী।
শহরের একাধিক চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাও বলছে, কালীপুজো পেরোতেই চেম্বারে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ইএনটি বিশেষজ্ঞরা যেমন জেরবার হন কান ও গলার সমস্যার রোগীদের নিয়ে, তেমনই পালমোনোলজিস্ট, মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে উপচে পড়ে কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির রোগীতে। চোখে জ্বালা, সংক্রমণ নিয়ে অনেকেই ছোটেন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে বাজি পোড়ানোর প্রবণতা বেশি। বড়দের তুলনায় এই দূষণে তাঁদের ক্ষতির আশঙ্কাও বেশি।
সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন
বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বাজির ধোঁয়ায় প্রচুর পরিমাণে সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড থাকে। এই সব বিষাক্ত ধোঁয়া ফুসফুসে চলে গেলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। শুকনো কাশিও হতে পারে। হাঁপানি রোগীদের অবস্থা প্রাণান্তকর হয়ে উঠতে পারে। বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এই ধরনের ধোঁয়া থেকে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষতির আশঙ্কা সব থেকে বেশি। সুস্থ লোকেরাও এই ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কালীপুজো পেরোতেই এই ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।’’ কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মতে, ‘‘হৃদরোগ রয়েছে এমন রোগীর দেহে আতসবাজির বিষাক্ত ধোঁয়া ঢুকলে তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
সঙ্গে শব্দবাজি
আতসবাজির বিপদের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে শব্দবাজির উৎপাত। ইএনটি বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘শব্দবাজির ক্ষেত্রে সাময়িক অথবা চিরস্থায়ী শ্রবণক্ষমতা হারানোর সমস্যা হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে শব্দবাজির দাপট আরও মারাত্মক হতে পারে। অনেকে চিরতরে বধিরও হয়ে যেতে পারে। শ্রবণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মাথা ঘোরা, মাথা ঝিমঝিম ভাব হতে পারে। কারও কানে আগে থেকে সমস্যা থাকলে হঠাৎ জোরে শব্দে মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারেন।’’ শহরের বহু ইএনটি চিকিৎসকের চেম্বারেই কালীপুজোর পড়ে কানের সমস্যা নিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ‘‘বেশির ভাগের কানের সমস্যা সেরে যায়। তবে বাজির দাপটে শোনার ক্ষমতা হারান, এমন অভাগার সংখ্যাও ফেলনা নয়,’’ বলছেন এক চিকিৎসক। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ তৃষিত রায় বলছেন, ‘‘শব্দবাজির জেরে প্রবীণদের উত্তেজনা বেড়ে যেতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে ঘুম নষ্ট হতে পারে।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে বড়দের সব উপসর্গগুলি দেখা যেতে পারে। তার উপরে নাগাড়ে শব্দবাজির আওয়াজে শিশুদের ক্ষেত্রে প্যানিক ডিসঅর্ডার দেখা যেতে পারে। বাজির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে শিশুদের খিদে কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অস্থির হয়ে উঠতে পারে একদম ছোটরা। শব্দবাজি রুখতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তাতে রয়েছেন শহরের নামী চিকিৎসকেরা। পর্ষদ সূত্রে বলা হচ্ছে, গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষেত্রেও শব্দবাজির দাপট ক্ষতি করতে পারে বলেও ওই কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন। এর পাশাপাশি, বড়দের ক্ষেত্রে শ্রবণক্ষমতা কমে যাওয়া, উত্তেজনা বৃদ্ধি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, ঘুম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থতার কথাও বলেছেন তাঁরা।
গায়ে এসে ফাটলে
রয়েছে বাজি থেকে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। অনেকেরই মত, এ রাজ্যে বাজি যে ভাবে তৈরি হয়, তাতে পেশাদারিত্ব থাকে না। অপটু হাতে বাজি তৈরি হওয়ার ফলে ওই সব বাজি মারাত্মক বিপদও ডেকে আনতে পারে।
দশ বছরের সায়নের পিঠের দগদগে ঘা শুকোতে লেগেছিল টানা চার মাস। চার বছর আগে কালীপুজোর দিন নীচু হয়ে প্রদীপের সলতেতে আগুন ধরাচ্ছিল ছেলেটি। সামনে থেকে একটি রকেট এসে ঘাড়ের কাছে ফেটে যায়। আগুন ধরে যায় জামায়। একেই শহরে অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসার সুযোগ কম। তার উপরে কালীপুজোর রাতে ছুটির মেজাজে ছিলেন সবাই। এ হাসপাতাল সে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল সায়নকে। ততক্ষণে পোড়া জামা ফোসকার সঙ্গে আটকে সে এক ভয়ানক ব্যাপার।
পরের দুই বছর কালীপুজোর সময়ে কলকাতায় আর ভয়ে থাকেনি সায়ন। সে পালিয়ে গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে।
বছর পাঁচেক আগে এক নামী চিকিৎসকের বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীর হাতে বাজি ফেটে গিয়েছিল। ওই চিকিৎসক বলছেন, ‘‘ওঁর ক্ষতবিক্ষত হাতের তালু কী ভাবে যে সারিয়ে তোলা হয়েছে তা আমিই জানি।’’
মাটিতে দৌড়োয় এমন বাজি ৬০ বছরের দীপক ভৌমিকের প্যান্টের নীচ দিয়ে ঢুকে গিয়ে কী যে বিপদ বাধিয়েছিল তা কালীপুজোর সময় এগিয়ে এলেই মনে পড়ে যায় বৃদ্ধের। পায়ে গভীর ক্ষত। ডায়াবেটিসের রোগী দীপকবাবুর ঘা সারতে লেগেছিল ছয় মাস। কালীপুজোর আগে পরে তিন দিন সন্ধ্যার পরে আর বাড়ির বাইরেই পা রাখেন না বৃদ্ধ।
বিপদ শিয়রে
সামনের সপ্তাহেই কালীপুজো। আলোর উৎসবে শহরজুড়ে শুরু হবে বাজির দাপট। আতসবাজির পাশাপাশি এ বার শহরে দেদার শব্দবাজি ফাটবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বাজির শব্দমাত্রা নিয়ে রাজ্য দূষণ পর্ষদ ও বাজি বিক্রেতাদের আইনি লড়াইয়ের ফাঁকেই মহানগরে ঢুকে পড়েছে প্রচুর শব্দবাজি। সেগুলিই এ বার প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলবে লোকজনের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy