ইতিহাস বলে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহাতাব ১৯০৮ সালে প্রথম ভারতীয় পূর্ণ সময়ের ক্লাব সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তাঁর ছেলে উদয় চাঁদ মহতাবও ক্লাবের সদস্য তথা ষ্টুয়ার্ড হন। এল সেই বিশেষ গৌরবোজ্বল দিন। দিনটা ছিল এক শীতের সকাল। তারিখ ৪ জানুয়ারি ১৯১২ সাল। ছয় ঘোড়ার জুরি গাড়ি করে মাঠে এলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। তার সঙ্গে রানি মেরি। রাজা অবশ্য ৫ বছর আগেই একবার রেসের মাঠ ঘুরে গিয়েছেন। মাঠে হাজির ছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্চ ও লেডি হার্ডিঞ্চ-সহ অনেক মানী লোকজন। সেদিন রেসের মাঠে জয়ীর হাতে কাপ তুলে দেন রাজা স্বয়ং। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
রাজপরিবারকে দেখার উদ্দীপনায় মাঠ তখন কানায় কানায় ভরা যা কী না জানা যায় সে আমলের খবরের কাগজের প্রকাশিত তথ্য থেকে। কলকাতা টার্ফ ক্লাবের নামের সঙ্গে রাজকীয় ব্যাপার অর্থাৎ রয়্যাল নাম যোগ হল। রয়্যাল কলকাতা টার্ফ ক্লাব নামটি শুধু ভারত নয় বিশ্বের ঘোড়দৌড়ের ইতিহাসের এক পরিচিত নাম। ১৯৬১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার রেসের মাঠের আর এক স্মরণীয় ঘটনা। উপস্থিত হলেন রানি এলিজাবেথ-২, সঙ্গে এলেন স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। সেই থেকে রানির সন্মানেই ‘ক্যুইন্স কাপ’ চালু আছে যা শীতকালীন সবচেয়ে বেশি দূরত্বের (২৮০০মিটার)। আজও প্রথা মেনে রানির কাছ থেকে সেই বিশেষ কাপ আসে। আবার রেসের ফলাফল রানির দফতরে পাঠানো হয় সেই পুরনো প্রথা মেনে।
বছরের বিশেষ দিনে গ্যালারি উপচে পড়ে উৎসাহী মানুষের ভিড়ে। যেমন ১লা জানুয়ারি, শীতকালীন ডার্বি, ক্যুইন্স কাপ আর বর্ষাকালীন ডার্বি। নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি চলে শীতকালীন দৌড়। আর বর্ষায় হয় আলাদা দৌড় যাকে বলা হয় মনসুন রেস। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মনসুন রেসের সময়। বর্ষায় রেসের ট্র্যাক বিশেষভাবে করা হয় যাতে খুব বৃষ্টিতেও জল না জমে, কলকাতার এই বিশেষ ট্র্যাক-এর সুনাম আছে। বছরের প্রথম দিন অনেকেই নানা সাজে মাঠে আসেন রেস প্রেমিরা। বিশেষ করে নানা রকম টুপি দেখা যায় রেসের মাঠে। এমন অনেকে আছেন এই বিশেষ দিনে বিশেষ সাজে আসেন মাঠে। সাধারণত শনিবার, রবিবার আর ছুটির দিন রেস কোর্সের গ্যালারি পোশাকের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। কুড়ি টাকার টিকিট কেটে রেসের মাঠে ঢোকা যায়। মাঠে মোবাইল ব্যবহারের বিধি নিষেধ আছে। সদস্যদের জন্য আলাদা বসার গ্যালারি আছে। সাধারণত শীতের সময় বেলা বারোটায় রেস শুরু হয়। তথ্য বলে কলকাতার ক্লাবের ঘোড়ার সংখ্যা আপাতত ৪০০ থেকে ৫০০। খুব ছোট থেকে আস্তাবলে ঘোড়াকে নানা ভাবে তৈরি করা হয় রেসের জন্য। জকিরা প্রতিদিন অনুশীলন করেন। রেসের আগে পিঠে লাগানো হয় নম্বর দেওয়া কাপড়। যাতে খুব সহজেই দূর থেকে জানা যায় কোন ঘোড়া জিতল। একদল সেই ঘোড়াদের নিয়ে আসেন ক্লাবের সামনে সুন্দর করে সাজানো ডিমের মতো সবুজ মাঠে যাকে বলা হয় প্যাডক। সেখানেই আসেন জকিরা ও সেখান থেকেই রওয়ানা দেন মাঠের দিকে। জকিদের পোশাক, টুপি নানান রকমের, আর শরীরের ওজন ৫০ কেজির মত। অনেকে মজা করে বলেন পেন্সিলের মত শরীর হয় জকিদের। কলকাতার মাঠে জকিরা কেউ কেউ বিদেশী। আবার অনেকে আছেন উত্তর ভারত, রাজস্থান ও দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। সকলেই প্রায় অবাঙালি। কোন জকির হাতে কোন ঘোড়া পড়বে তা নির্বাচন করেন ঘোড়ার ট্রেনাররা আর তাতেই ঘোরে ভাগ্যের চাকা। প্যাডকে ঘোড়ার পিঠের উপর সওয়ার হয়ে জকিরা রেসের মাঠে নামেন। এবার যাত্রা স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে। সেখানে নম্বর লাগানো খাঁচার মধ্যে ঘোড়াদের ঢুকিয়ে এবার অপেক্ষা স্টার্টারের সংকেতের। ব্যাস দৌড় শুরু। মাঠে জায়েন্ট স্ক্রিনে রেসের ছবি দেখার সুযোগ আছে দর্শকদের। কারণ, বাস্তবের দৌড়ের ঘোড়া তখন চোখের সীমা থেকে অনেক দূরে। দূরবিনে চোখ রাখেন অনেকে। কয়েক পলক পড়তেই একটা মোড় ঘুরে ছুটে আসছে এক দল ঘোড়া আর তাদের পিঠে বিশেষ ভঙ্গীতে জকিরা। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
ফিনিশিং পয়েন্টের কাছাকাছি আসতেই দর্শকদের চিৎকার আর ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ, মাইকের ধারা বিবরণী সব মিলেমিশে একাকার হয়ে কি এক অদ্ভুত উন্মাদনা। প্রত্যেক রেসের শেষে জয়ীকে আবার প্যাডকে পুরস্কৃত করা হয়। ডার্বির পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান হল অবশ্য মাঠে। রেসের বিষয়ে এক রকম ছোট বই পাওয়া যায় যাতে সে দিনের দৌড়ের ব্যাপারে অনেক তথ্য থাকে সেই বই নিয়ে অনেকে নানা হিসেব করেন যা সারা রেসকোর্সের খুব পরিচিত দৃশ্য। বড় বড় জায়েন্ট স্ক্রিনে বা ডিজিটাল স্কোর বোর্ডে রেসের নানান তথ্য থাকে যা দেখে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরতে সুবিধা হয়। এ বছর ১২ জানুয়ারি মূল আকর্ষন কলকাতা শীতকালীন ডার্বি গ্রেড ১ (২০১৯-২০২০) ২৪০০ মিটার দৌড়ের জয়ী ঘোড়া হল ট্রাফালগার আর জকি ছিলেন ডেভিড এ্যালান। তথ্য বলে, এই ডেভিড এ্যালান কিন্তু বর্ষাকালীন ডার্বিতেও জয়ী হন। ভারত বিখ্যাত জকিদের মধ্যে আছেন বেঙ্গালুরুর সুরজ নারেডু। ঐতিহ্যবাহী ‘ক্যুইন্স কাপ’-এর দৌড় হয় ২৮০০ মিটার-এর। যা ভারতের দীর্ঘতম দৌড়ের মধ্যে অন্যতম। দৌড় শেষে ক্লাবের পক্ষ থেকে সুন্দর দেখতে ট্রফিটি তুলে দেওয়া হয় জয়ীদের হাতে।যারা বাজি হারেন তারাও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেন বিজয়ীর দিকে।
রেসের মাঠ আর শুধু ঘোড় দৌড় থাকে না বরং তা হয়ে ওঠে, মানুষের জীবনের প্রতিনিয়ত ‘দৌড়’-এর এক অতি বাস্তব প্রতিফলন। মহানগরের কংক্রিট জঙ্গলের বুকে সবুজ মখমলের মতো ঘাসে মোড়া কলকাতা রেসকোর্সের ২০০ বছরে গৌরবময় ঘোড়দৌড়ের ইতিহাস তার ধারাবাহিকতায় অমলিন। অন্য খেলার সঙ্গে এই রাজকীয় খেলা অবশ্যই অন্য স্বাদের যা না দেখলে অনেক কিছুই দেখা হয় না। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy