ফাইল চিত্র।
‘‘পরিবেশ রক্ষা করতে বারবার নানা সময়সূচি ঠিক করেছ তোমরা। আবার তোমরাই সেই সময়সূচি মানোনি।’’— ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক নেতাদের ঔদাসীন্যকে এ ভাবেই তিরস্কার করেছিলেন সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ। দেশের কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে যে গ্রেটার টুইট ঘিরে বর্তমানে উত্তাল দেশ-বিদেশ। কিন্তু
অষ্টাদশীর এই প্রতিবাদের পাশাপাশি যদি শুক্রবার বিধানসভায় রাজ্যের অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের ঘটনাকে রাখা যায়, তা হলে দেখা যাবে এখানেও পরিবেশের প্রতি সেই একই ‘ঔদাসীন্য’। তাই বাজেট-বক্তৃতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সড়ক-সহ বিভিন্ন খাতের উল্লেখ থাকলেও পরিবেশ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না। বাজেট-নথিতে পরিবেশ খাতের উল্লেখ ও নিয়মমাফিক বরাদ্দটুকু ছাড়া সে প্রসঙ্গ ‘উপেক্ষিত’ই থাকে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, এক অদ্ভূত বিপ্রতীপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। যেখানে গ্রেটার মতো অল্পবয়সিরা জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষার জন্য গলা ফাটাচ্ছেন, সেখানেই পরিবেশ রক্ষার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের তরফে নিস্পৃহতা লক্ষ করা যাচ্ছে সারা বিশ্বে। পশ্চিমবঙ্গও যার ব্যতিক্রম নয়।
অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বাজেট শুরু করেছেন আমপান-অতিমারির প্রসঙ্গ দিয়ে। বলেছেন, ‘‘জীবাণু সর্বগ্রাসী, প্রকৃতি সংহারমুখী এবং ভারত সরকার কর্তব্যবিমুখ— এই অভূতপূর্ব প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের যুঝতে হয়েছে বিগত বছরটা।’’ ফলে এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পরিবেশকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘আসলে ভোটের বাজারে পরিবেশের কাটতি নেই। তাই বাজেট-নথিতে উল্লেখ থাকলেও বাজেট-বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী তার নামোল্লেখ
করেন না।’’
যদিও বিষয়টিকে এ ভাবে দেখতে নারাজ রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। তিনি জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার পরেই একদম শেষের দিকে চলে গিয়েছিলেন। মাঝের যে পাতাগুলো পড়েননি, সেখানে পরিবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা রয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়ে সৌমেনবাবু জানাচ্ছেন, ২০১৯-’২০ ও ২০২০-’২১ সালে যেখানে পরিবেশ খাতে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৮৩.৩৫ কোটি এবং ৯৩.৪২ কোটি টাকা, সেখানে এ দিন তা বেড়ে হয়েছে ৯৭.৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ দু’বছরে এই খাতে প্রায় ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। তা ছাড়া আমপানে সবুজের ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে চারাগাছ রোপণ, কাঠ-কয়লা জ্বালানির পরিবর্তে এলপিজি স্টোভ বিতরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ধুলো-দূষণ নিয়ন্ত্রণে ৪০টি ওয়াটার স্প্রিঙ্কলার গাড়ির ব্যবস্থা, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক তৈরি-সহ একগুচ্ছ পদক্ষেপের কথার উল্লেখ রয়েছে বাজেট-নথিতে। সৌমেনবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যদি পরিবেশকে গুরুত্বই না দিতেন, তা হলে এতগুলি পরিকল্পনা এবং ক্রমান্বয়ে পরিবেশ খাতে বরাদ্দ বাড়ত কি?’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ খাতে সরকারি বরাদ্দ যে বাড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু করোনা সংক্রমণের সময়ে পরিবেশের প্রসঙ্গ আলাদা ভাবে উল্লেখের প্রয়োজন ছিল।’’ আর এক পরিবেশবিদ আবার জানাচ্ছেন, বাজেট-নথি যত জন পড়বেন, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ বাজেট-বক্তৃতা শুনেছেন। ওই পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘বিশেষ করে যেখানে অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বাজেট পড়ছেন!’’
‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অরুণাভ মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘আমরা যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেখানে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই পরিবেশকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’’
‘‘ফাঁকা বুলি দিয়ে তোমরা আমার স্বপ্ন কেড়েছ, আমার শৈশবটাই কেড়ে নিয়েছ।’’—রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমনটাই বলেছিলেন গ্রেটা। কিন্তু এ রাজ্যের পরবর্তী প্রজন্মের যাতে ‘স্বপ্নভঙ্গ’ না হয়, তা রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসক দল, তা সে যে রাজনৈতিক দলই হোক না কেন, তাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy