দায়িত্বে: নবনিযুক্ত ডেপুটি হাই কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস। সোমবার, বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
আড়াই দশক আগে বাবার ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য প্রথম বার এ শহরে আসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তিনি অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষ। নার্সিংহোমের বাইরে তাকানোর ফুরসতই পাননি।
শল্য চিকিৎসায় ডান পা বাদ যাওয়ার পরেও বাবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হাসছিলেন, “গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়ে আমার পা-টা শেষমেশ কলকাতায় থেকে গেল!” এত দিন বাদে তাঁর পুত্র অন্য ভূমিকায় এ শহরে পদার্পণ করছেন। আজ, মঙ্গলবার বাংলাদেশের নতুন ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার নিচ্ছেন সে-দিনের সেই সদ্য যুবা, আন্দালিব ইলিয়াস।
‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’র লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম শুনলে টান-টান হয়ে বসেন বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রেমীরাও। ক্যানসারে অকালপ্রয়াত গদ্যকার মাত্র দু’টি উপন্যাস লিখেই এ ভাষার শ্রেষ্ঠতম এক সাহিত্যিকের আসনে নন্দিত। তবে পুত্র আন্দালিব সবিনয়ে বলছেন, “কালচারাল লেগ্যাসি (সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার) জিনে থাকে না! আমি বরং ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়েই স্বচ্ছন্দ।”
প্রায় দু’দশকের কূটনীতিকের জীবনে জেনিভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ম্যানিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল, ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের হয়ে ব্যাট ধরেছেন। ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টের সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে এক বেলার জন্য কলকাতায় আসেন।
দিল্লিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে সর্বস্তরে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলির ভাইপো সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি। নবনিযুক্ত ডেপুটি হাই কমিশনার হয়ে আখতারুজ্জামানের পুত্র বলছেন, “আমি একটা সোনালি সময়ে ভারত বা কলকাতায় এসেছি। দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সম্পর্কটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অসম্ভব আন্তরিক সম্পর্ক। আমি চাইব সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পাশাপাশি ব্যবসা, তথ্যপ্রযুক্তিতেও দুই বাংলার যোগাযোগ বাড়াতে।” তাঁর বিদায়ী পূর্বসূরি তথা কাছের বন্ধু তৌফিক হাসানের শুরু করা কিছু কাজেও হাত দিতে হবে আন্দালিবকে। জোড়াসাঁকোয় বাংলাদেশ গ্যালারি তৈরি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপকের চেয়ার গঠনের কথা চলছে। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মাখা ২৮টি বাড়ি নিয়ে কিছু বিশেষ পরিকল্পনাও রয়েছে।
১৯৯৬-এ ‘খোয়াবনামা’র জন্য আনন্দ পুরস্কার নিয়ে বাঙালি জাতির সংস্কৃতির গোড়ায় অভিন্ন সত্তার কথা বলেছিলেন আখতারুজ্জামান। আফশোসও করেছিলেন, কী ভাবে নানা অপশক্তির হাতে সেই সত্তাটি ধ্বস্ত হচ্ছে। ব্যক্তিজীবনে ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম আন্দালিব বলছিলেন, “আমি ঢাকায় অজস্র হিন্দু বন্ধুর মাঝে বড় হয়েছি। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে ঘোরা ছাড়াও সেন্ট গ্রেগরিজ় স্কুলের পরিবেশে মিশে ছিল বিভিন্ন সংস্কৃতির শিকড়। গির্জায় ফাদারেরা খুব মজার আমেরিকান বিস্কুট খাওয়াতেন। আর স্কুলের খ্রিস্টান শিক্ষকদের বাড়িতে জুটত নিজেদের বেক করা কেক! এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি।” বাবার অন্যতম প্রিয় শহর কলকাতায় এখন রকমারি সুখাদ্য, ট্রাম সফর বা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি অভিযানের জন্যেও আন্দালিব শিশুর মতো উত্তেজিত।
সুকুমার রায়ের অসম্ভব ভক্ত হিসেবেও কলকাতার একটা আলাদা ব্যঞ্জনা রয়েছে তাঁর কাছে। “আমি কবিতা অত বুঝি না! তবে কখনও কোথাও দু’টি মাত্র বই বাছতে হলে চোখ বুজে ‘আবোলতাবোল’ তুলে নেব”— হেসে বলছেন আন্দালিব। দু’নম্বরে ‘হযবরল’ না ‘গীতবিতান’ কে থাকবে, তা অবশ্য ভাববার বিষয়!
নানা স্পর্শকাতর বিষয়ে সমাজমাধ্যমের খিটিমিটি-মুখর দিনকালে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশে কূটনৈতিক দায়িত্বের চ্যালেঞ্জটাও ভাবাচ্ছে। আন্দালিব বলছেন, “বাবার কাছে দু’টি জিনিস শিখেছি। ধৈর্য এবং মানবিকতাবোধ! কূটনীতিকের এই দুটো কাজে লাগে। আর আলোচনায় সব কিছুরই নিষ্পত্তি সম্ভব।”
কূটনীতিকের বর্ম গায়ে থাকলেও আখতারুজ্জামান কথিত ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ গড়ার ব্যাটনই এখন তাঁর পুত্রের হাতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy