Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

সাততলা সমান নীচ দিয়ে এগোচ্ছে সুড়ঙ্গ, গঙ্গা আর মাত্র ৩০০ মিটার!

‘‘পাতালের মাটি খুঁড়ে যন্ত্রটি প্রতিদিন এগোচ্ছে ১২ মিটার করে। এ ভাবে এগোলে ৩০০ মিটার যেতে আরও মাস দুয়েক। তার পরেই গঙ্গার নীচে ঢুকব আমরা।’’

মেট্রোর সুড়ঙ্গে চলছে কাজ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

মেট্রোর সুড়ঙ্গে চলছে কাজ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

দেবাশিস দাশ
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:৪২
Share: Save:

‘‘পাতালের মাটি খুঁড়ে যন্ত্রটি প্রতিদিন এগোচ্ছে ১২ মিটার করে। এ ভাবে এগোলে ৩০০ মিটার যেতে আরও মাস দুয়েক। তার পরেই গঙ্গার নীচে ঢুকব আমরা।’’

মাটির নীচে প্রায় সাততলা গভীরতায় ৫.৫ মিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর নির্মাণকারী সংস্থা ‘কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর এগ্‌জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার উত্তম কর্মকার। সামনেই সুড়ঙ্গ কাটার দৈত্যাকার টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) কর্কশ শব্দে মাটি কেটে চলেছে। তার উপরে দাঁড়ালে বোঝা যাচ্ছে, খুব ধীরে হলেও যন্ত্রটা কাঁপতে কাঁপতে এগোচ্ছে সামনের দিকে।

হাওড়ার দিকে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার পরে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ শুরু হয়েছে। এগোচ্ছেও দ্রুত গতিতে। কেএমআরসিএল-এর দাবি, সব ঠিকঠাক চললে আগামী জানুয়ারির প্রথম দিকেই গঙ্গার ১৩ মিটার নীচ দিয়ে মেট্রো রেলের ৫৮০ মিটার লম্বা সুড়ঙ্গপথ তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাবে। আর সেই কাজটাই এই প্রকল্পের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

নিরাপত্তার সমস্ত নিয়ম মেনে হাওড়া ময়দানে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সাইট অফিস থেকে উত্তমবাবু এবং তাঁর সঙ্গী, টানেল ইঞ্জিনিয়ার বিপ্লব সাহার সঙ্গে মাটির প্রায় ৭০ ফুট নীচে নেমে মনে হয়েছিল, সত্যিই একটা কর্মযজ্ঞ চলছে। সামনে কলকাতামুখী দু’টি সুড়ঙ্গের মুখ। সেফটি ক্যাপ ও মেট্রোর নির্দিষ্ট জ্যাকেট পরা কর্মীরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। হাওড়া ময়দানের যে জায়গা থেকে সুড়ঙ্গ শুরু হয়েছে, তার সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখান দিয়েই সুড়ঙ্গের মাটি ক্রেনের সাহায্যে তোলা হচ্ছে উপরে।

সুড়ঙ্গের মুখ থেকে কিছু দূর এগোনোর পরে সেটি প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে পূর্ব রেলের লাইনের নীচ দিয়ে চলে গিয়েছে হাওড়া স্টেশনের দিকে। কাজ চলায় গোটা পথটাই এখন জল-কাদায় মাখামাখি। এক দিকে প্রায় দেড় ফুট উঁচুতে হাঁটার একটি অস্থায়ী পথ তৈরি হয়েছে। পথ মানে তারজালির দেড় ফুট চওড়া, ছ’ফুট লম্বা এক-একটা লোহার ফ্রেম। পরপর সাজানো। তার উপর দিয়েই সামনের দিকে এগোনোর ফাঁকে সঙ্গী ইঞ্জিনিয়ারেরা বলে দিচ্ছিলেন, মাটির নীচে ঠিক কোথায় আছি আমরা।

সুড়ঙ্গে ঢোকার পরেই টের পাচ্ছিলাম, ভিতরের উষ্ণতা অনেকটাই বেশি। অক্সিজেন কম থাকায় শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছুটা কষ্টও হচ্ছিল। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পরে বোঝা গেল, ইতিমধ্যে জেলা গ্রন্থাগার, কেলভিন কোর্ট, পূর্ব রেলের হাওড়া শাখার রেললাইন ও বঙ্কিম সেতু পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছি হাওড়া স্টেশনের নীচে। সেখানেই এখন কাজ করছে সুড়ঙ্গ কাটার যন্ত্র।

ইঞ্জিনিয়ারেরা জানালেন, মূল যন্ত্রটি আট মিটার লম্বা হলেও আনুষঙ্গিক যন্ত্র রয়েছে ৮০ মিটার। যন্ত্রটি মাটি কাটার সঙ্গে সঙ্গে তা যেমন কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে লোকো ট্রেনের বগিতে, তেমনই বৃত্তাকার সুড়ঙ্গের চারপাশে বিশেষ ভাবে তৈরি কংক্রিটের স্ল্যাব বা ‘লাইনার সেগমেন্ট’ (যা চারপাশের মাটিকে ধরে রাখে) নিখুঁত ভাবে বসানোর কাজও করছে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। উত্তমবাবু জানান, এত বড় যন্ত্রটি পরিচালনা করছেন মাত্র ১০ জনের একটি দল। সকলেই টিবিএমের বিশেষজ্ঞ। যন্ত্রের মধ্যে থাকা কন্ট্রোল রুম থেকে সুড়ঙ্গের দেওয়ালে এক-একটা কংক্রিটের বলয়ের ৬টি ভাগ নিঁখুত ভাবে বসাচ্ছেন তাঁরাই।

গোটা কর্মযজ্ঞ চলছে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক। গর্ত থেকে বেরোনো মাটি, দু’-তিন টন ওজনের এক একটি কংক্রিটের স্ল্যাব টিবিএম যন্ত্রের কাছে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা লোকো ট্রেন। সেই ট্রেন চলাচলের জন্য লাইন পাতা হয়েছে সুড়ঙ্গে। কাজ যত এগোবে, সেই লাইনও তত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মেট্রোর নির্মাণকারী সংস্থা কেএমআরসিএলের বক্তব্য— হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর লাইনের বেশির ভাগটাই যেহেতু সুড়ঙ্গে, তাই এর কাজে প্রথম ও প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টিকে। সে জন্য সুড়ঙ্গে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি জিনিসই যেমন পরীক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে, তেমনই কর্মীদের নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সুড়ঙ্গের মধ্যে।

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর নির্মাণকারী সংস্থার দাবি, দেশের মধ্যে এই প্রথম কোনও নদীর নীচ দিয়ে এত বড় সুড়ঙ্গপথ তৈরির কাজ শুরু হবে। সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, সুড়ঙ্গ কাটার টিবিএম গঙ্গার নীচে প্রবেশ করলে নিরাপত্তার কারণে কাজ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করা যাবে না।

ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, একে গঙ্গা দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্তত ১৩ ফুট উচ্চতার জলের চাপ, তার উপরে সুড়ঙ্গের দু’পাশে মাটির চাপ— এই দুই কারণে যন্ত্র বন্ধ হলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যন্ত্রটি সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি সংস্থার তরফে নিরাপত্তার সব রকম প্রস্তুতি খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়েছে এখন থেকেই।

কেএমসিআরএলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বনাথ দেওয়ানজির বক্তব্য, তাঁদের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল, দেশের অন্যতম বড় রেল ইয়ার্ড হাওড়া স্টেশনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখে কাজ করা। তাঁর দাবি, সেই কাজ সফল ভাবে শেষ হয়েছে। এখন গঙ্গার নীচে সুড়ঙ্গ কাটার কাজ শেষ করাটাই তাঁদের পরবর্তী মূল লক্ষ্য। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘আমরা হাওড়া স্টেশনের ৪০০ মিটার লম্বা ২৩টা রেল ট্র্যাক পেরিয়েছি পুরোপুরি নির্বিঘ্নে। এক দিনও ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়নি। এখন সামনে একটাই বড় চ্যালেঞ্জ, তা হল গঙ্গা।’’

কেএমসিআরএলের কর্তাদের বক্তব্য, নদীর নীচে এত বড় সুড়ঙ্গ কেটে মেট্রোর কাজ আগে হয়নি। তাঁদের ধারণা, গঙ্গার নীচে সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ হলে ২০১৭ সালের জুলাই মাসের মধ্যে মেট্রো মহাকরণ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তার পরে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত বাকি কাজটা ২০১৯-এর নির্ধারিত সময়েয়র মধ্যেই শেষ করা যাবে।

অন্য বিষয়গুলি:

East -West Metro Howrah
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy