আঁকতে ব্যস্ত শ্রীয়ঙ্ক। নিজস্ব চিত্র
স্কুলের সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় অঙ্কে কুড়িতে কুড়ি পেয়েছে চতুর্থ শ্রেণির শ্রীয়ঙ্ক দত্ত। ছবি এঁকেও আগের মতোই বাহবা পাচ্ছে। নিজের অনেক কাজও করে নিতে পারছে সে। দু’হাতের বুড়ো আঙুল একটুও কষ্ট দিচ্ছে না তাকে।
সাত মাস আগে এই দু’টি বুড়ো আঙুলই কেটে তার গৃহশিক্ষকের ফ্ল্যাটে লিফটের ভিতরে পড়ে গিয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল শ্রীয়ঙ্ক ওই অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে রক্তমাখা দুই হাত নিয়ে পৌঁছেছিল রাস্তার উল্টো দিকে, তার দাদুর দোকানে।
এই ঘটনার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে শ্রীয়ঙ্কে বাড়ির লোক খুঁজে খুঁজে আঙুল দু’টি কুড়িয়ে প্লাস্টিকে মুড়ে নিয়ে যান হাসপাতালে। সারা রাত ধরে দীর্ঘ সাত ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পরে দু’টি আঙুলই নিপুণ ভাবে জুড়ে দেওয়া গিয়েছে শ্রীয়ঙ্কের হাতে। দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগেই স্কুলে যেতে শুরু করেছিল সে। লেখাপড়া, আঁকা, খেলাধুলো— সবই চলছে পুরোদমে। পরিজনেদের ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটেছে। তৃপ্ত চিকিৎসকেরাও। তবে তাঁরা চিন্তিতও। তার কারণ অবশ্য শ্রীয়ঙ্ক নয়। তাঁদের দুশ্চিন্তার কারণ, বারবার হাত বা আঙুল আটকে কেটে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও কোল্যাপসিবল দরজা লাগানো লিফট নিষিদ্ধ ঘোষণা করার তাগিদ কোনও তরফে দেখা যাচ্ছে না।
যে চিকিৎসক শ্রীয়ঙ্কের অস্ত্রোপচার করেছেন, সেই প্লাস্টিক সার্জন অনুপম গোলাসের কথায়, ‘‘প্রতি বছর ১-৩টি করে এমন ঘটনা পাচ্ছি। বিশেষ করে বাচ্চাদের এই দুর্ঘটনা হচ্ছে।’’ প্লাস্টিক সার্জনদের ব্যাখ্যায়, লিফট নিয়ে বাচ্চাদের অনেকেরই কৌতূহল থাকে। খেলার ছলে বারবার ওঠানামা করতে তারা ভালবাসে। সেটা করতে গিয়েই কখনও কখনও দরজার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বোতাম টিপে আর হাত বার করতে পারে না। অথবা কেউ হয়তো দরজার মধ্যে হাত ঢুকিয়েছে, ঠিক সেই সময়েই অন্য কোনও তলায় কেউ বোতাম টিপে দিল। লিফট চলতে শুরু করল। হাত বার করতে না পারলে তখন হাত বা আঙুল কেটে যায়। প্রাপ্তবয়স্করাও অনেকে বাইরের দরজা বন্ধ করার পরে ভিতরের দরজা ঠিক করে বন্ধ করা বা উল্টোটা করতে যান। তখনও হাত আটকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
অনুপমবাবু বলেন, ‘‘কোল্যাপসিবল দরজা লাগানো লিফট অবিলম্বে তৈরি করা বন্ধ করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করা উচিত সরকারের।’’ একই কথা বলছেন বিশিষ্ট প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রত্যেক বছর লিফটে হাত বা আঙুল কাটার একাধিক কেস পাই। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কোনও সভ্য দেশে কোল্যাপসিবল দরজা লাগানো লিফটের অস্তিত্ব নেই। অথচ ভারতে তা নিষিদ্ধ করা হয় না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই রকম দুর্ঘটনার পরে দ্রুত কাটা অঙ্গ নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসকের কাছে পৌঁছনোর সৌভাগ্য অনেকেরই হয় না। তাঁরা চিরকালের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যান।’’
উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীর বাসিন্দা শ্রীয়ঙ্কর ক্ষেত্রে অবশ্য চিকিৎসা পেতে দেরি হয়নি। তার বাবা উত্তম দত্ত জানান, পাড়ায় শিক্ষকের বাড়িতে একাই যেত শ্রীয়ঙ্ক। গত ২৬ এপ্রিল পড়ার পরে শিক্ষক নীচে পৌঁছে দিয়েছিলেন শ্রীয়ঙ্ককে। তিনি ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওয়ার পরে শ্রীয়ঙ্ক উপরে উঠে লিফটের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বোতাম টেপার চেষ্টা করে। তখনই নীচ থেকে এক জন লিফটের বোতাম টেপেন। শ্রীয়ঙ্ক সময় মতো হাত বার না করতে পারায় তার দু’হাতের বুড়ো আঙুল কেটে লিফটের মধ্যে পড়ে যায়। উত্তমবাবুর কথায়, ‘‘প্রথমে একটি সরকারি হাসপাতালে ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে বলল, দরকারি কোনও একটি যন্ত্র খারাপ। তাই অস্ত্রোপচার হবে না। তার পরে আমরা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সকলের সেই আর্থিক ক্ষমতা নাও থাকতে পারে। তাই কোল্যাপসিবল গেটের লিফট তৈরিই বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy