হাসিমুখে: পসরা নিয়ে আসিরুল। ধর্মতলা চত্বরে, শনিবার। ছবি: শৌভিক দে।
মেরি ক্রিসমাস! আপনার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ছোট ভ্যান গাড়িটা থেকে ভেসে আসবে এই দু’টো শব্দ। আপনি হয়তো দু’মিনিট দাঁড়াবেন, গাড়ি থেকে বেছে নেবেন একটা লাল টুপি কিংবা ছোট্ট ক্রিসমাস ট্রি। মনে মনে কুর্নিশ করবেন বিক্রেতাকে। গাড়ি এগিয়ে যাবে তত ক্ষণে।
গাড়িটা পুরনো হয়ে গিয়েছে অনেক। আগের মতো আর চলে না। দশটা নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে, মোমিনপুর থেকে ধর্মতলা আসতে লেগে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা। রাতে ফেরার সময়ে রাস্তা একটু খালি থাকে, আর একটু কম সময় লাগে তাই।
গাড়ি বলতে, তিন চাকার এক লজ্ঝড়ে ভ্যান। ডান হাত দিয়ে হাতল ঘোরালে, চাকা ঘোরে। বাঁ হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সামনের ডান্ডা। ওটা দিয়েই ঠিক হয় গাড়ি কোন দিকে যাবে। এ রকমই একটা গাড়ি দিনভর ঘুরে বেড়ায় ধর্মতলা চত্বরে। আসলে একটা নয়, অনেকগুলোই। প্রতিবন্ধীদের এমন গাড়িতে বেশির ভাগেই রাখা থাকে ভিক্ষাপাত্র। হয়তো একটানা বেজে চলে ভাঙা রেকর্ডার। এমন ছবিই পরিচিত। কিন্তু এই গাড়ি অন্যদের থেকে আলাদা। এ গাড়ি বোঝাই হয়ে রয়েছে নানা রকমের লাল সান্তা টুপি, ছোট বাচ্চাদের রকমারি হেয়ারব্যান্ড, আলোজ্বলা নকল শিং, ফুলের টায়রা, খেলনায়। আসিরুলের নিজের মাথাতেও লাল সান্তা টুপি। ভিড় ঠেলে গাড়ি চালাতে চালাতেই সকলকে উইশ করছেন, ‘মেরি ক্রিসমাস’। কেউ থামালে থামছেন, বিক্রি করছেন পসরা। আবার এগোচ্ছেন নিজের মতো।
মোমিনপুরের বাসিন্দা, আসিরুল হকের দু’বছর বয়সে পোলিও হয়েছিল। পায়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর বাড়েনি তার পর থেকে। ও ভাবেই বড় হয়েছেন ‘প্রতিবন্ধী’ তকমা নিয়ে। বাবা জন্মান্ধ। স্থানীয় মসজিদে মৌলবি হিসেবে নিযুক্ত। অভাবের সংসারে অনেক ভাইবোন একসঙ্গে বড় হতে হতেই নিজের নিজের রোজগারের পথ বার করেছেন। কেউ জনমজুর, কারও বা ছোটখাটো ব্যবসা। আসিরুলের রোজগারের পথ যেন এক রকম ঠিকই হয়েছিল। ভিক্ষা। পরিবারের সকলে এমনটাই বলেছিলেন আসিরুল একটু বড় হওয়ার পরে।
‘‘আমাদের মতো গরিব ঘরে এমনটাই হয়। কোনও সন্তানের শারীরিক খুঁত থাকলে ধরেই নেওয়া হয়, তাকে দিয়ে ভিক্ষাই করানো হবে,’’ বলছিলেন আসিরুল। কিন্তু কিশোর বয়স ছোঁয়ার সময় থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, আর যা-ই হোক ভিক্ষা করবেন না। ‘‘পা নেই তো কী হয়েছে, হাত তো আছে! মাথা তো আছে! আত্মসম্মান তো আছে!’’, সাফ যুক্তি তাঁর। এই যুক্তিতেই দিনে দেড় টাকা বেতন হিসেবে রাস্তার ধারে মালিকের ডালা নিয়ে বসতেন। ডালা ভর্তি পাতিলেবু। তার পরেও আরও বহু কাজ করার চেষ্টা করেছেন বহু জায়গায়। ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করেছেন। মূলধন আর শারীরিক সক্ষমতা— এ দুটোর অভাব বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছর দশেক আগে অল্প অল্প জিনিস কিনে এ ভাবেই নিজের তিনচাকা ভ্যানে করে বেচতে শুরু করেন ঘুরে ঘুরে।
কথা বলতে বলতেই আলো জ্বলা প্রজাপতি লাগানো হেয়ারব্যান্ডের বায়না নিয়ে এসে পড়ে এক খুদে। মিষ্টি হেসে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানান আসিরুল। নিজে হাতে পরিয়ে দেন হেয়ারব্যান্ড। পয়সা নেন খুদের মায়ের কাছ থেকে। ফের বলে চলেন। বাড়িতে স্ত্রী আছেন, আছে দুই মেয়ে। সকাল সকাল তৈরি হয়ে গাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ধর্মতলা চত্বরটাই বেছে নিয়েছেন গত কয়েক বছর ধরে। শীতের সময়ে সান্তা সেজে বিক্রি করেন বড়দিনের নানা উপহার। বাকি সময় কখনও চুড়ি, কখনও খেলনা, কখনও অন্য কিছু। সোমবার করে জিনিসপত্র কিনতে যান বড়বাজারে। সারা দিনের বিক্রি শেষে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়। তাই দিয়েই চলে সংসার।
বস্তুত, এত লড়াইয়ের পরেও এখনও পর্যন্ত ভিক্ষার পরামর্শ পিছু ছাড়েনি আসিরুলের। এত দিন ছিল পরিবার, এখন হয়েছে ধর্মতলা এলাকার ‘দাদা’রা। ভিক্ষা করার জন্য আসিরুলকে নানা রকম চাপ দেন তাঁরা। ব্যবসার চেয়ে ভিক্ষার ‘রেট’ বেশি ওই চত্বরে। আর এ ক্ষেত্রে আসিরুলের বাড়তি ‘সুবিধা’ রয়েছে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। ‘‘বহু অসুবিধা। দাদারা দেখতে পারে না। জবরদস্তি করে ভিক্ষা করানোর জন্য। অন্য ব্যবসায়ীদেরও রাগ রয়েছে। ওরা ভাবে, প্রতিবন্ধী বলে বেশি জিনিস বিক্রি হয় আমার। ভিক্ষা করলে অন্তত ওদের এক জন প্রতিযোগী কমত। কিন্তু যা-ই হয়ে যাক, যত দিন বাঁচব, খেটেই রোজগার করব,’’ জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে বলেন আসিরুল।
যিশুপুজোর প্রাক্কালে শহর জুড়ে উৎসবের মরসুম। চার দিকে সান্তা ক্লজের ছোট-বড় প্রতিকৃতি সেজেছে। নকল সান্তা সেজে মনোরঞ্জন করছেন কত মানুষ। আর এর মধ্যেই রোজ ধর্মতলার ভিড়ে মিশে, শত বাধার পাহাড় টপকে, ছোট ছোট মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন সত্যিকারের এক সান্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy