ধ্বংসাবশেষ: মুর অ্যাভিনিউয়ে ভেঙে পড়া বাড়ির সামনে রাজু বিশ্বাস। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
ক্ষোভ আর একরাশ আক্ষেপই এখন সঙ্গী আমপানের কবলে পড়ে এ শহরে মৃতদের পরিজনেদের। আজ, শনিবার ২০ জুন আমপান আছড়ে পড়ার এক মাস পূর্তি। তার আগের দিন, শুক্রবার সেই স্বজনহারাদের অভিযোগ, কিছু ঘটলে প্রথমে শোরগোল হয়। পরে সবাই ভুলে যান। আমপানে এ শহরে ১৯ জনের মৃত্যুর পরেও তা-ই হয়েছে।
মে-র ২০ তারিখ আমপান আছড়ে পড়ার পরে কোথাও সাত দিন, কোথাও তারও বেশি সময় বিদ্যুৎহীন হয়ে ছিল শহরের বেশ কিছু অংশ। দিকে দিকে জলের জন্য চলেছিল হাহাকার। সেই সময়ে পুর-প্রশাসনের অসহায় অবস্থাই প্রকট হয়েছিল। এতগুলি মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছিল, আগাম খবর সত্ত্বেও ঝড় নিয়ে প্রশাসনের প্রস্তুতি তবে কোথায় ছিল?
শুক্রবার এই প্রশ্নই তুললেন পর্ণশ্রীর পুনীতকওর শেঠি। সেই রাতে ঝড়ের পরে তাঁর জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়ে আর ফেরেননি ছোট ছেলে পাভনীত শেঠি। ভোরে বাড়ি থেকে পাঁচশো মিটার দূরে তার জড়ানো অবস্থায় উদ্ধার হয় বছর তিরিশের পাভনীতের দেহ। পুনীত বলেন, “এই মৃত্যুতে কি পুরসভা, বিদ্যুৎ সংস্থার কোনও দায় নেই? ওই দিন সারা রাত পাড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে কী হতে পারে, কেউ এক বারও ভাবলেন না!” বৃদ্ধ বলে চলেন, “আমার ওষুধ কিনতে গিয়েই তো শেষ হয়ে গেল। নিজেকে ক্ষমা করব কী করে? সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ চাই না। তবে কোনও বাবা-মাকে যেন সন্তানহারা না-হতে হয়, সেটা অন্তত দেখুক।”
ঝড়ের পরের দিন পর্ণশ্রী থানা এলাকা থেকে পাভনীত ছাড়াও উদ্ধার হয়েছিল আরও চারটি মৃতদেহ। পুলিশ জানিয়েছিল, রাস্তায় ছিঁড়ে পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই তাঁরা সকলে মারা গিয়েছেন। ঝড় থামার পরে বৃষ্টিতে আটকে পড়া আত্মীয়াকে পৌঁছে দিতে বেরিয়েছিলেন ওষুধ সংস্থার গাড়িচালক বছর সাঁইত্রিশের পিন্টু গায়েন। ফেরার পথে ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুতের তারে পা পড়ে যায় তাঁর। স্বামীর নিথর দেহ দেখার কথা এখনও মনে করতে পারেন না অপর্ণা। ন’বছরের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তিনি বলেন, “যাঁর যায়, তিনিই বোঝেন। এখনও ওই তারের জট সরল কোথায়! ঘুরে দেখুন, কত জায়গায় ঝুলছে তার। এত মৃত্যুতেও হুঁশ হয়নি।”
একই অভিযোগ মানিকতলা লালাবাগান এলাকার বাসিন্দা সরস্বতী অধিকারীর। বস্তির চিলতে ঘরে জায়গা কম। প্রতি রাতে বাড়ির কাছের ফুটপাতে তাই প্লাস্টিক টাঙিয়ে শুতেন তাঁর বছর সাতাশের ছেলে রাহুল। সরস্বতীর কথায়, “ঝড়ে ওই প্লাস্টিক উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই পাড়ার এক বন্ধুর বাড়ি শুতে যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল ছেলেটা। ভোরে পুলিশ ফোন করে থানায় যেতে বলে। তত ক্ষণে সব শেষ।” মহিলার আক্ষেপ, “গাড়ি চালিয়ে রোজগার। সেই টাকা জমিয়ে বড় ঘর ভাড়া নেবে বলেছিল ও। সতর্ক ভাবে চলাফেরাও করত। বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার সময়ে ভেঙে পড়া বাতিস্তম্ভটা আর ওর চোখে পড়েনি।”
রিজেন্ট পার্কের মুর অ্যাভিনিউয়ে বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল মা এবং ছেলের। মৃত কমলা বিশ্বাসের বয়স ৬০। আর ছেলে পিন্টুর ২৮। বড় ছেলে চল্লিশোর্ধ্ব রাজু বিশ্বাস বললেন, “ঝড়ের কিছু ক্ষণ আগেই বাড়ির কিছুটা চাঙড় খসেছিল। মা তখন চা বানাচ্ছে আর ভাই খাটে শোয়া। চা খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মাকে বলছিলামও। কথাটা শেষ করা যায়নি। চোখের সামনেই মা আর ভাইয়ের উপরে ভেঙে পড়ে পাঁচিল। আমিও আহত হই। অনেক রাতে যখন পাঁচিল সরিয়ে পুলিশ দেহ বার করল, তখন কিছু অবশিষ্ট নেই।” ভেঙে পড়া পুরনো বাড়ির সব জিনিস নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন অবিবাহিত রাজুর সম্বল, একটি থালা আর ভাইয়ের মোবাইল। নিজের ফোনটা দেওয়ালে চাপা পড়ে ভেঙেছে। কান্না জড়ানো গলায় রাজু বলেন, “নম্বরটা তো ভাইয়ের। কত লোক ওকে ফোন করছেন। লোকজনকে ওর খবর জানাতে আর ভাল লাগছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy