প্রতীকী চিত্র।
সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম লগ্ন থেকেই সমাজের এক শ্রেণির মানুষ বার বার কাঠগড়ায় তুলেছেন কোভিডের চিকিৎসায় যুক্ত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। বাদ যাননি আক্রান্ত রোগীরাও। গত ছ’মাসে সেই পরিস্থিতি যে বদলায়নি, কিছু ঘটনা তারই প্রমাণ।
গত মাসের ১৯ তারিখ কলকাতা থেকে এক বাচিক শিল্পী ও অভিনেতা বোলপুরের কাছে দ্বারোন্দায় গিয়েছিলেন দিন তিনেকের ছুটি কাটাতে। শিল্পী জানাচ্ছেন, সেখানে এক ঘরোয়া আড্ডায় গান ও কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল। এর পরে জ্বর নিয়ে কলকাতায় ফেরেন ওই শিল্পী। কোভিড পরীক্ষা করালে রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। অভিযোগ, সে খবর জানিয়ে শিল্পী তাঁর সংস্পর্শে আসা সকলকে সতর্ক করে দিতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অশালীন ভাষায় ট্রোল করা শুরু হয় তাঁকে। তিনি যে কোভিড পজ়িটিভ, তা জেনেশুনেই দ্বারোন্দায় গিয়েছিলেন ওই শিল্পী এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে এসেছেন— এমন রটনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শিল্পীর দাবি, তিনি শহরে ফেরার আগে কিছুই জানতেন না। তবে তাঁর যে আরও বেশি সচেতন হয়ে সর্বক্ষণ মাস্ক ও গ্লাভস পরা উচিত ছিল, তা স্বীকার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমা চেয়ে নেন ওই শিল্পী। তিনি জানান, এক শ্রেণির মানুষের আক্রমণ করার এই প্রবণতা তাঁকে কোভিডের থেকেও অনেক বেশি করে বিপর্যস্ত ও ধ্বস্ত করেছে।
সংক্রমিতকে কোণঠাসা করার ব্যাপারে পিছিয়ে নেই পঞ্চাশ বছরের পুরনো প্রতিবেশীরাও। উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা, বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা ২৬ দিন সল্টলেকের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। যার মধ্যে প্রায় ১৭ দিন তাঁকে ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছিল। বৃদ্ধার দুই বিবাহিতা মেয়ে দূরে থাকেন। তাই একা বাড়িতে ছিলেন তাঁর বৃদ্ধ স্বামী। অভিযোগ, কোভিড নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও ওই বৃদ্ধ প্রতিবেশীদের থেকে বিন্দুমাত্র সাহায্য পাননি। পাশে থাকেনি কলকাতা পুরসভাও।
আরও পড়ুন: কাজ গিয়েছে করোনায়, মাথায় হাত ডেকরেটরদের
পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওই দম্পতির দাবি, বাড়ি জীবাণুমুক্ত করাতেই পাঁচ বার ফোন করতে হয়েছিল পুর প্রতিনিধিকে! আরও অভিযোগ, বৃদ্ধা সুস্থ হওয়ার এক মাস পরেও পুরনো পরিচারিকাকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি প্রতিবেশীরা। রান্না থেকে ঘরদোর পরিষ্কার— সব কাজই করছেন সদ্য কোভিড থেকে সেরে ওঠা বৃদ্ধা নিজেই। সঙ্গ দিচ্ছেন স্বামী।
অবহেলার আর একটি নমুনা দেখেছেন হাওড়া ময়দান এলাকার একটি আবাসনের বাসিন্দা এক দম্পতি। দু’জনেই কোভিড পজ়িটিভ হয়ে ফ্ল্যাটের একটি ঘরে আইসোলেশনে ছিলেন। গৃহকর্তার মা এবং দম্পতির নাবালিকা মেয়ে তাঁদের বাইরে থেকে সাহায্য করেছেন। অভিযোগ, এ ক্ষেত্রেও প্রতিবেশীরা তো দূর, খোঁজ নেয়নি হাওড়া পুরসভাও। বর্তমানে সুস্থ দম্পতি কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে তাঁদের বাইরে বেরোতে দেখলেই তড়িঘড়ি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। ওই আবাসনে পাম্প চালানোর দায়িত্ব ঘুরে ঘুরে পড়ে প্রতিটি পরিবারের উপরে। আপাতত নিদান জারি হয়েছে, ওই পরিবার যেন পাম্পের সুইচে হাত না দেয়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল পরিচিত দৃষ্টিতেও ওঁরা যেন ভিন্ গ্রহের জীব।
দক্ষিণ কলকাতার একটি আবাসনের বাসিন্দা, বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক লকডাউনেও নিয়মিত রোগী দেখছিলেন। তার পরে নিজেই সংক্রমিত হন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অনেক দিন। তবে তিনি আবাসনের লিফটে উঠলে সঙ্গে ওঠেন না প্রতিবেশীরা। পুরনো গাড়িচালক কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন চালক না-পেয়ে নিজেই দুর্বল শরীরে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে রোগী দেখতে যাচ্ছেন ওই চিকিৎসক।
মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে, এ সবের একমাত্র কারণ মানসিক সঙ্কীর্ণতা। শিক্ষাও তা দূর করতে পারে না। বরং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের ‘সবজান্তা’ মনোভাব থেকেই তৈরি হয় এমন দৃষ্টিভঙ্গি। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, “প্রবাদেই আছে, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। এটাই বেশির ভাগের চরিত্র। সেখানে প্রতিবেশী বা আত্মীয় তো কোণঠাসা হবেনই। এই চরিত্র বদলাতে মানুষকে অনেকটা পথ যেতে হবে। অতএব, এই সঙ্কীর্ণতা নিয়েই এখন চলতে হবে।”
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy