কাছাকাছি: উল্টোডাঙা এলাকার এক বস্তি। ছবি: সুমন বল্লভ
বাড়ি নয়। তাঁদের রয়েছে শুধুই ঘর। সেই একটি মাত্র ঘরে কোথাও পাঁচ জন, কোথাও পরিবারের সাত-আট জনের বাস। সেখানে মহিলাদের পোশাক বদলের সময়ে পুরুষদের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। রাতে ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা ঘরে ঘুমোলে বড় ছেলেদের নিয়ে বাবাকে যেতে হয় পথে। কখনও হয়তো পাড়ার ক্লাবে শোয়ার জায়গা হয় অনেকের সঙ্গে।
করোনা-আতঙ্কের এই পরিস্থিতিতে শহরের এই ধরনের বস্তিগুলিতে বাসিন্দাদের পক্ষে কি সর্বক্ষণ ঘরে থাকা সম্ভব? সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা? কয়েক দিন ধরে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে। অনেকে বলছেন, যে সব মানুষের পক্ষে একটা গোটা দিন ঘরের মধ্যে কাটানো সম্ভব নয়, তাঁরাই একে অপরের মাধ্যমে দ্রুত সংক্রমণের শিকার হবেন না তো?
সাম্প্রতিক অতীতে এই সমস্ত বস্তিতেই ডেঙ্গি-মৃত্যুর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও সেখানে ঘুরে দেখা গেল, অবস্থা কিছুই বদলায়নি। ডেঙ্গি মরসুমের মতো স্রেফ ব্লিচিং ছড়িয়েছে স্থানীয় পুর-প্রশাসন।
সংক্রমণ এড়াতে ছোঁয়াচ বাঁচানো কি আদৌ সম্ভব এই বস্তিবাসীদের পক্ষে? সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, “মানুষের দিন কাটানোর যে স্বাভাবিক জায়গা দরকার, তার সামান্যতমও এই বস্তিতে থাকে না। এটাই হয়তো আগামী দিনে সমস্যার জায়গা হতে চলেছে। সমাজের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করলে আর রক্ষে নেই।” তাঁর পরামর্শ, বস্তিবাসীদের আলাদা করে বোঝানো দরকার। তাঁর কথায়, ‘‘আলাদা করে কথা না বললে ওঁরা ভাববেন, আমাদের পরিস্থিতি না-জেনেই সকলের জন্য এক নিয়ম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এতে বিরোধ বাড়বে, কিন্তু সচেতনতা বাড়বে না।”
গল্ফ গার্ডেনের ঝোড়ো বস্তিতে এ ভাবেই থাকেন বাসিন্দারা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
ডেঙ্গির মরসুমে যাদবপুরের বেঙ্গল ল্যাম্প কারখানার কাছের এক বস্তিতে অন্তত তিন জনের মৃত্যু হয়েছিল। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ছোঁয়াচ বাঁচানোর ন্যূনতম প্রচেষ্টাই সেখানে নেই। কিছু মানুষ চাতালে চাটাই পেতে একসঙ্গে শুয়ে, কেউ কেউ আবার একসঙ্গে গল্পগুজব বা তাস খেলায় ব্যস্ত। ঘর থেকে বেরোচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনে বিরক্ত সেখানকার বাসিন্দা রাম সাহা বললেন, “ঘরে চার ভাই, মা আর বোন। এত জন মিলে সর্বক্ষণ ঘরে থাকা যায়!” গুলি খেলা থামিয়ে দোকান থেকে লজেন্স কিনে এনে আর একটি শিশুকে খাওয়াতে দেখা গেল বস্তিবাসী এক নাবালককে। হাত পরিষ্কারের কোনও বালাই নেই।
গল্ফ গার্ডেনের ঝোড়ো বস্তির রাস্তার মোড়ে আবার জটলা। লকডাউনের কোনও প্রভাবই যেন নেই। অথচ গত বছর ডেঙ্গিতে এখানে মৃত্যু হয় এক ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বার। মৃতার ভাই সানি সামন্ত বললেন, “কী করে ঘরে থাকব? জায়গাই তো নেই। জল নিতে পাড়ার একটা কলে ১২টি ঘরের লোকের লাইন পড়ে। একটা শৌচাগার ব্যবহার করে পাঁচ-ছ’ঘর লোক। অত মানলে চলে নাকি!”
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “ভারতকে নিয়ে এই কারণেই এত ভয়। এখানে বহু মানুষ চাইলেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারবেন না। সেই পরিসরই নেই। আর এটা না বুঝেই আমরা পাড়ার জটলার ছবি পোস্ট করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়।”
উল্টোডাঙা থানার সামনের বস্তিতে বছর ছয়েকের মেয়েকে রেখে ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছিল এক তরুণীর। তাঁর শ্বশুর মিন্টু সাউ জানালেন, নাতনিকে নিয়ে তাঁরা এখন ঘরবন্দি। কিন্তু বস্তির বাকিরা? তাঁরা রয়েছেন সেই রাস্তাতেই। মিন্টু বলেন, “পুলিশ মাঝেমধ্যে এসে মেরে তাড়াচ্ছে। কিন্তু তার থেকে তো একটু বোঝালে পারে! বোঝালে যা-ও বা কাজ হতে পারে, মেরে কিছু হবে না।”
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy