বেহাল: কলকাতা মাদ্রাসা কলেজের (এখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) গেটের পাশের ফুটপাতে আবর্জনার স্তূপ। দাঁড় করানো রয়েছে ঠেলা, রিকশাও। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
‘‘হাঁটাচলার জায়গা নেই। দু’দণ্ড দাঁড়ানোর সুযোগ যদি বা কখনও পাওয়া গেল, নাক-মুখ না ঢেকে উপায় নেই। আমাদের গ্রামে চলুন, বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাবেন।’’
কোলাহলমুখর লেনিন সরণিতে দাঁড়িয়ে এমনই আক্ষেপ করছিলেন বনগাঁর অসীম দাস। পাশে দাঁড়ানো কল্যাণীর দিব্যজ্যোতি রায় তাঁর কথা শুনে হেসে বললেন, ‘‘মশাই, গাড়ির কালো ধোঁয়ার দূষণে ফুসফুসে কালশিটে পড়ে গিয়েছে!’’
ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ সংলগ্ন মোড়ে গাড়ি থেকে অবিরাম বেরোনো কালো ধোঁয়া দেখে এমনই নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। ছ’নম্বর বরোর প্রসঙ্গ উঠতেই সবার আগে আসে কলকাতার ‘প্রাণকেন্দ্র’ এই অঞ্চলের কথা। ধর্মতলা মানে কত কী! ছোট-বড় হরেক কিসিমের দোকান, ব্রিটিশ আমলের গ্র্যান্ড হোটেল, ফুটপাতে ঢালাও পসরা সাজিয়ে বসা বিক্রেতাদের হাঁকাহাঁকি, সারা দিন ধরে বাস-গাড়ি-ট্রাম ও লোকজনের চলাচল। সঙ্গে ‘উপরি পাওনা’ কেব্ল সংযোগের তারের জঙ্গল আর পার্কিংয়ের তীব্র সমস্যা।
কল্লোলিনী কলকাতা এই ভার বয়েই পথ হাঁটছে। সঙ্গে রয়েছে যন্ত্রণাও। ধর্মতলা থেকে কিছুটা দূরেই ঐতিহ্যমণ্ডিত হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার। তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে খোলা ভ্যাটের দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। ওই ভ্যাটের অদূরেই সুপ্রাচীন কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ। অধুনা যা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত। ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে এই আদি কলেজের প্রতিষ্ঠা। ঠিক উল্টো দিকে দু’টি বিশাল সরকারি ছাত্রাবাস (বেকার এবং ইলিয়ট)। ১০০ মিটার গেলে মৌলানা আজাদ কলেজ। মাদ্রাসা কলেজ, তার ছাত্রাবাস— সব হেরিটেজ তালিকাভুক্ত।
অথচ, সুদৃশ্য সেই ভবনগুলির সামনে দিয়ে গেলে মনে হয়, হেরিটেজ এলাকার এমন করুণ দশা! হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারের এক পাশে খোলা ভ্যাট, অন্য পাশ প্রায় পুরোটাই ঝুপড়িবাসীদের দখলে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলছেন, ‘‘মধ্য কলকাতা তথা ছ’নম্বর বরোর অন্যতম মুখ এই হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার। বিদেশ থেকে পর্যন্ত প্রচুর দর্শনার্থী এটি দেখতে আসেন। কিন্তু এখানকার কদর্য চেহারায় আমাদের লজ্জা হয়।’’
সমস্যার কথা স্বীকার করে ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর সানা আহমেদের আশ্বাস, ‘‘জিতে এলে আমার প্রথম কাজই হবে খোলা ভ্যাট সরানো। ঝুপড়িবাসীদের সরিয়ে হেরিটেজ এলাকার সৌন্দর্যায়নে আরও সচেষ্ট হব।’’
এক দিকে ধর্মতলা, চাঁদনি চক, নিউ মার্কেট, জানবাজার। অন্য দিকে বেনিয়াপুকুর, এন্টালি। মাঝে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, তালতলা, মৌলালি, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, ইলিয়ট রোড, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড। বিস্তীর্ণ এই অংশ নিয়েই ছ’নম্বর বরোর অবস্থান। বস্তুত, কলকাতার ব্যস্ততম প্রাণকেন্দ্র বলা ভাল। সরকারি-বেসরকারি বহুতল, একাধিক বাজার, বিপুল গাড়ির চাপ, তা থেকে বেরোনো ধোঁয়ার দূষণ, কয়েক লক্ষ মানুষের বসবাসের পাশাপাশি আরও কয়েক গুণ বেশি মানুষের যাওয়া-আসা, দৈনন্দিন তৈরি হওয়া আবর্জনা— সব নিয়েই চলেছে এই বরো এলাকা। ফলে দিন যত গড়াচ্ছে, সমস্যাও তত বিস্তৃত হচ্ছে।
এখানকার অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সিংহভাগের মুখে উঠে এল জল জমার কথা। যা নিয়ে সরব বিরোধীরাও। ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী চৈতালি ভৌমিক নায়ার, ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী মানজার এহসান বা ওই ওয়ার্ডেরই কংগ্রেস প্রার্থী নাদিম মহম্মদ দে-র কথায়, ‘‘বৃষ্টিতে রাস্তা তো ডোবেই, জল ঢোকে বস্তির ঘরেও।’’
যদিও এই অভিযোগ পুরোপুরি মানতে চাননি তৃণমূল প্রার্থী থেকে শুরু করে প্রাক্তন পুর প্রতিনিধিরা। তাঁদের দাবি, আগে বৃষ্টি হলে কয়েক দিন জল দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু বরো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় নিকাশির সংস্কার হওয়ায় সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখন বৃষ্টি হওয়ার পরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জল নেমে যায়। তবে কিছু জায়গায় যে সমস্যা রয়েছে, তা মানছেন ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর মনজ়র ইকবাল। বললেন, ‘‘রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের নীচে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ইটের নিকাশি নালার অবস্থা খুবই সঙ্গিন। একটু ভারী বৃষ্টি হলে জল সরানোর ভার নিতে পারছে না। একমাত্র উপায় বিকল্প নিকাশি লাইন তৈরি করা।’’ ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সাজিদ ইসমাইলের অভিযোগ, জল জমার পিছনে অন্যতম কারণ, নিকাশি নালাগুলি নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়া।
অভিযোগ রয়েছে পানীয় জল নিয়েও। এস এন ব্যানার্জি রোড লাগোয়া কয়েকটি এলাকা থেকে শুরু করে বেশ কিছু ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পানীয় জলের চাপ খুব কম। এর সঙ্গে দৃশ্যদূষণ বাড়াচ্ছে এক দিকে আবর্জনা, অন্য দিকে হোর্ডিং, ব্যানার। যদিও ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর গোপালচন্দ্র সাহার দাবি, নিয়মিত আবর্জনা সাফাই হয়।
এলাকার হেরিটেজ বাড়িগুলির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। যদিও বিপরীত ছবিটাও দেখা গিয়েছে। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে বো ব্যারাকের সংস্কার করা হয়েছে। যা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়েরা।
এলাকাবাসীর একাংশ সরব আরও একটি বড় সমস্যা নিয়ে— বেআইনি নির্মাণ। যদিও তা মানতে নারাজ বিদায়ী পুর প্রতিনিধিরা। ছ’নম্বর বরোর অধীন এন্টালির পদ্মপুকুরের দুই ওয়ার্ড, ৫৪ আর ৫৫ নম্বরে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের বড় অংশ জুতো তৈরির ব্যবসায় জড়িত। সব মিলিয়ে সংখ্যা কয়েক হাজার। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, রোজ সিআইটি রোডের উপরে জুতোর পসরা নিয়ে বসেন তাঁরা। অথচ, বাম আমলে তাঁদের পুনর্বাসনের জন্যই বিদ্যাসাগর মার্কেট তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেই বাজার এখনও দিনের আলো দেখেনি। বিরসুলহাট লেদার হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি দিবাকর ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘বাজারের বাড়িটি প্রায় ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে পড়ে আছে। একাধিক বার পুরসভায় দরবার করেও সমাধান হয়নি। আরও একটা ভোট এসে গেল। ওই বাজারটি অবিলম্বে তৈরি করে জুতো ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি।’’
ব্যবসায়ীদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর অরুণকুমার দাস বলেন, ‘‘বাড়িটির সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে। তা হলে গরিব ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।’’ পাশের ওয়ার্ডের (৫৪) বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর তথা পুরসভার বাজার দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য আমিরুদ্দিন ববি বলেন, ‘‘বাড়িটি কলকাতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের কথা অবশ্যই ভাবা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy