জীর্ণ: বিপজ্জনক হয়ে পড়া বহু পুরনো একটি বাড়িতে পুরসভার তরফে লাগানো হয়েছে নোটিস। বিডন স্ট্রিটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেউ হুড়মুড়িয়ে নীচে পড়ছেন। কেউ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন মাথার উপরে ছাদ ভেঙে পড়ায়। অনেকেই আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছেন প্রাণ হাতে করে। ঝড়-বৃষ্টি এলে বাড়িতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। তবু যেন শহরের পুরনো বাড়ির বিপদ কাটছে না! বহু ক্ষেত্রেই পুরসভা বিপজ্জনক নোটিস ঝুলিয়ে গেলেও প্রাণ হাতে করেই বসবাস চলছে সেখানে। পুলিশ-প্রশাসনের সচেতনতার প্রচারও কাজে লাগছে না!
রবিবারই পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট ভবনের এক দিকের চাঙড় ভেঙে পড়ায় জখম হয়েছেন এক পথচারী। গত শুক্রবার রাতে ল্যান্সডাউনের পদ্মপুকুর রোডের একটি পুরনো বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ায় আটকে ছিলেন এক দিকের ভাড়াটেরা। জানা গিয়েছে, পুরসভা বাড়িটিতে বিপজ্জনক নোটিস ঝোলালেও বাড়ি ছাড়তে চায়নি এক ভাড়াটের পরিবার।
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, সংস্কার প্রয়োজন, এমন পুরনো বাড়ির সংখ্যা শহরে এই মুহূর্তে প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে ৫০০টি বাড়ি এমন রয়েছে, যেখানে কালবিলম্ব না করেই ভাঙার কাজ শুরু করা প্রয়োজন। এর মধ্যে ৩৬০টি বাড়ি বিপজ্জনক তালিকাভুক্ত। মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হাওড়ার দিকে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে এমনই একটি বাড়ি। চারতলা ওই বাড়িটির দেওয়াল জুড়ে গাছের সারি গজিয়ে উঠেছে। সিঁড়ি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বেশ কিছু জায়গায়। বৃষ্টি হলে জল তো পড়েই, ছাদের অংশও খসে পড়তে থাকে যখন-তখন। এই অবস্থাতেও এই বাড়িতে থাকেন কেন? সেখানকার ভাড়াটে স্বপন ঘোষ বললেন, ‘‘বাড়ির সংস্কার মালিকের বিষয়। আমরা পুরনো ভাড়াটে। ছেড়ে যাব কেন?’’ বাড়ির মালিক শক্তিপদ ঘোষের দাবি, ‘‘ভাড়াটেরাই বাড়ি সারাতে গেলে বাধা দিচ্ছেন।’’ একই দাবি এ জে সি বসু রোডের একটি বাড়ির মালিকের। ওই বাড়ির একাংশ ভেঙে গত বছরই এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। মৃত ব্যক্তির পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও এখনও সেখানে সাত ঘর ভাড়াটের বাস। তাঁদেরই এক জন, নিমাই সর্দার বললেন, ‘‘রাস্তায় বেরিয়েও তো মৃত্যু হতে পারে!’’
বছরখানেক আগেই বাড়ি ভেঙে মৃত্যু হয়েছিল পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট এবং ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে। সেখানেও বিপজ্জনক বাড়ি আঁকড়ে রয়েছেন বাসিন্দারা। ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে আবার সেই ভেঙে পড়া বাড়ির পাশেরটিও হেলে রয়েছে অন্য বাড়ির দিকে। একই রকম অবস্থা কিছু দিন আগেই ভেঙে পড়া গিরিশ পার্কের একটি বাড়িরও। সেখানকার বাসিন্দাদের এক জন আবার বললেন, ‘‘অনেক ঝড়-বৃষ্টি দেখেছি। কিছু হওয়ার হলে এত দিনে হয়ে যেত। উঠে গেলে সব হাতছাড়া।’’
পুরসভা সূত্রের দাবি, ভাড়াটেদের অনেকেই মনে করেন, এক বার উঠে গেলে আর বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই জটিলতা কাটাতেই মেয়র ফিরহাদ হাকিম ঘোষণা করেছেন, ভাড়াটেদের এক ধরনের শংসাপত্র দেওয়া হবে। বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে তা দেখিয়েই পুরনো জায়গা নিশ্চিত ভাবে পাওয়া যাবে। কিন্তু তার পরেও জটিলতা কাটছে না। পুরকর্তারা জানাচ্ছেন, বছর পাঁচেক আগে পাশ হয়েছিল পুর আইন ৪১২ (এ)। এতে পুরনো বাড়ি সংস্কারে উৎসাহ দিতে একাধিক ছাড়ের ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, বিপজ্জনক বাড়ি ঘোষণা করে পাঠানো নোটিসকে ‘কনডেমড’ নোটিস বলে ধরা হবে। এতে মালিককে বাড়ি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হবে। সে জন্য ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিয়ো’র (এফএআর) ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হবে। বাড়ির মালিক ওই কাজ করতে না পারলে সংস্থা লাগিয়ে করবে পুরসভাই। কিন্তু মালিককেই খরচের বিষয়টি দেখতে হবে। এর পরে পাশ হয় ১৪২ নম্বর পুর আইন। এই আইন অনুযায়ী, ভাড়াটেরা যে জায়গা ভোগ করছেন, তার সম পরিমাণ জায়গা ছাড় হিসাবে পেতে পারেন বাড়ির মালিক। কিন্তু এত ছাড়েও সমস্যা মেটেনি?
এক পুরকর্তা বলেন, ‘‘মালিককে সুবিধা দিতে গিয়ে চারপাশের ছাড়ের জায়গা কমে যাচ্ছে। দমকল আপত্তি করছে। জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, এমন বহু ভাড়াটে রয়েছেন, যাঁরা সংস্কারের সময়ে জায়গাটুকু ছেড়ে যাওয়ার জন্যও টাকা চাইছেন। অর্থাৎ, তৈরি হয়ে গেলে পুরনো জায়গা তো নেবেন-ই, সঙ্গে টাকাও চাই!’’ আর এক পুরকর্তার মন্তব্য, ‘‘পুরসভা সংস্কার করাতে গেলে অন্য শরিকেরা মামলা ঠুকে দিচ্ছেন। মামলার বোঝাই বা পুরসভা নেবে কেন! এতেই সব আটকে যাচ্ছে!’’
তা হলে উপায়? মেয়রের মন্তব্য, ‘‘মানুষ না চাইলে কিছুই করা যায় না। পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy