পরম্পরা: দুপুর শেষের শান্ত পাড়ায় খুনসুটি বাবা-মেয়ের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
শীতের ফসল, ঘরোয়া ওয়াইনের স্বাদটা মিষ্টি। একটু বেশি মিষ্টি।
বছর শেষের এক বিকেলে সেই আঙুরের রক্ত একটা ছোট গেলাসে চেখে দেখতে দিয়েছিলেন আন্টি অ্যানা। কাঁচাপাকা চুলের কালোকোলো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেমসাহেবদের সখী-সমাবেশে আড্ডা তখন বেশ ফুরফুরে। ফোনে অর্ডার করা ওয়াইন কিনতে আসা আগন্তুককে আদর করে আন্টিরা বলছিলেন, নিউ ইয়ার ইভ-এর পার্টিটা এখানে বেড়ে হয়! বৌকে, গার্লফ্রেন্ডকে— যাকে খুশি নিয়ে চলে এসো!
এই বর্ষায় সেই ফ্ল্যাটের বাইরে সিঁড়ির চাতালটা নতুন করে চুনকাম হয়েছে। ঠিক উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে রোগা ফিতের মতো ড্রয়িং স্পেসের সোফায় একদা বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়-সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়কে অবাক হয়ে বলেছিলেন, এইটুকুনি ফ্ল্যাটে থাকেন কী করে! এখন সেখানটায় সপরিবার থাকেন গীতার পুত্রপ্রতিম ভাগবত জানা। দোতলার বারান্দা থেকে তিনি দেখাচ্ছিলেন, চাঁদা তুলে লাল টুকটুকে বাড়িগুলোর ভিতর-বাইরে মেরামতি করে কী ভাবে টিকে আছেন সক্কলে।
বাড়িগুলো জরাজীর্ণ বলে দু’দশক আগেই হাত তুলে নিয়েছিল সাবেক মালিক ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। সব ভেঙে প্রোমোটারির পরিকল্পনা ছকে ফেলা হয় তড়িঘড়ি। ভাগ্যিস, তা ঘটেনি। তাই এখনও টিকে কলকাতার শতাধিক বছরের বর্ণময় জীবনের স্মারক। তবে কেউ ভাড়া নেয় না, রক্ষণাবেক্ষণও করে না। জলের জোগান সীমিত। এই টুলু পাম্পের যুগেও বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট চামড়ার মশক কাঁধে হাজির ভিস্তিওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু লাল ইটের ‘ম্যাট ফিনিশ’ বাড়িগুলোর দু’কামরা-তিন কামরা-এক কামরার ফ্ল্যাটে ১৩০-৩২টা পরিবারের জীবনের রং ফিকে হয়নি।
বৌবাজার থানার ঠিক পিছনে, চিলতে গলি বো স্ট্রিট লাগোয়া তল্লাটের নামই বো ব্যারাক। ১০০ বছর আগের লাল টুকটুকে বাড়িগুলোর না কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সেনাদের থাকার জন্য পত্তন হয়। সাবেক লাল ইটের আয়তক্ষেত্রাকার চত্বরে ভরবিকেলে ফেলিক্স অগাস্টিন, চিনা ভারতীয় যুবা কুচি চইরা ‘আঙ্কল লাল’কে দেখে স্বাগত জানান। এ পাড়ার চার দশকের বাসিন্দা হিন্দির স্কুলশিক্ষক বেনারসি লাল একদা হাফপ্যান্ট পরে আরএসএস-এর প্যারেডে যেতেন। অর্ডারমাফিক নানা কিসিমের বিফ-পর্ক রান্নার জন্য বিখ্যাত পড়শি রিচার্ড বা জ্যানিসের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাবে অবশ্য কোনওকালে অসুবিধা হয়নি। পাড়ার এই বুজুর্গরা ছাড়াও দিব্যি হেসেখেলে আছেন গুজরাতি নলিন শাহের মেয়েজামাই, বিধানসভার আধিকারিক শ্যামল দত্ত, হাইকোর্টের উকিল হাসান সাহেব, রেলের অফিসার সুশীল বাঁড়ুজ্জে কিংবা পঞ্জাবি বেরী-খুরানিরা। এই ২০১৭-য় জাতিসত্তা নিয়ে প্রশ্নে দীর্ণ বৃহত্তর ভারতের সংশয়ের কাঁটা হেলায় উপড়ে ছুড়ে ফেলেছে এই বো ব্যারাক।
ঝিমধরা দুপুরের বারান্দায় বসে একদা হকি মাঠের চ্যাম্পিয়ন সাসেলি সেভিয়েল, ফ্রেডেরিক রোজারিওদের কথা ভেবে অবশ্য বিষণ্ণ হন কোনও প্রৌঢ়। পিচ রাস্তার উঠোনটায় এখনও হকি মাঠের ছক কাটা। ফি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আশপাশের পাড়াকে ডেকে হকির টক্কর এ মহল্লা মাতিয়ে রাখত। ছেলেপুলেদের জড়ো করতে না পেরে এ বছর হকি প্রতিযোগিতা বাতিল করতে হয়েছে। তবে ১৫ অগস্টের ছুটিতে ফুটবলের আসরে নড়চড় হতে দেবেন না পাড়ার মাতব্বররা।
তরুণ তুর্কি ম্যাথু ন্যাথানিয়েল, আনকোরা ডিজে ডমিনিক আলেক্সান্ডারদের আড্ডায় অবশ্য অস্ট্রেলিয়া-কানাডার নামগুলো ঘুরপাক খায়। কিন্তু অনেকে দেশান্তরী হলেও এখনও আছেন অনেকেই। সন্ধেয় ডমিনিকের মা ডিওনের রান্না চিনে মুখরোচকের সুগন্ধে মালুম হয় জীবনের উত্তাপ।
রঙিন সহাবস্থানের মন্ত্রই এখনও শেষ কথা বলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy