Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ক্রিসমাস কেকের আমেজও ম্লান আইনের জুজুতে

নিউ মার্কেটের সমান বয়সী কেকের দোকান ইম্পিরিয়ালের কর্তা শেখ জাহাঙ্গির রহমানেরও এক সুর। বলছেন, ‘‘আমরা অন্তত চার পুরুষ না হয় এই তারকেশ্বর লাইনের পুড়শুড়ায় জন্মেছি!

ব্যস্ততা: বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তা, তবু বড়দিনের আগে চলছে কেক তৈরির কাজ। বৌবাজারের একটি কারখানায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

ব্যস্ততা: বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তা, তবু বড়দিনের আগে চলছে কেক তৈরির কাজ। বৌবাজারের একটি কারখানায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৫৪
Share: Save:

দূর দেশে এসে সাতসকালে ‘কলকাতা ওয়াকে’ বেরিয়ে আভেন-গরম কেকের টুকরোটা মুখে দিয়ে বিগলিত জার্মান পর্যটক। ‘আহা, এ তো ঠাকুরমার তৈরি ঘরোয়া ক্রিসমাস কেক মনে পড়ে গেল!’ বৌবাজার থানার কাছে কয়লার সেই বিশাল আদ্যিকালের চুল্লির সামনে দাঁড়িয়ে তবু মনমরা অর্ধশতক আগের ‘মিস্ত্রি’ শেখ সৈয়দ রহমান। ‘‘এনআরসি নিয়ে ভাবব, না বড়দিনের কেকের অর্ডার সামলাব!’’— বলে উঠলেন সেই প্রবীণ।

নিউ মার্কেটের সমান বয়সী কেকের দোকান ইম্পিরিয়ালের কর্তা শেখ জাহাঙ্গির রহমানেরও এক সুর। বলছেন, ‘‘আমরা অন্তত চার পুরুষ না হয় এই তারকেশ্বর লাইনের পুড়শুড়ায় জন্মেছি! জমিজিরেতের সব কাগজপত্তর রয়েছে। কিন্তু কারখানার শ্রমিক থেকে ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত পড়া লোকজন কী কাগজ দেবেন বলুন তো? এ দেশের দিন আনি-দিন খাই হিন্দু-মুসলিমের ক’জন পরিচয়ের নথি খুঁজে পাবে বলতে পারেন?’’

খিদিরপুরের ওই সংস্থার কেকের কারখানায় রীতিমতো দুশ্চিন্তার পরিবেশ। বড়দিনের আগে বৌবাজারের শতাব্দীপ্রাচীন আজমিরি বেকারির বিশাল কর্মযজ্ঞও কার্যত বেসুরে বাজছে। দিন কয়েক আগে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধী মিছিলের সময়ে কাজ ফেলে কিছু ক্ষণ রাস্তার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রমিকেরা। কাজের চাপে মিছিলে পা মেলানো হয়নি। তবু অনেকেরই মন মিশে রয়েছে রাজপথের আন্দোলনে। আজমিরি-র কর্তা শেখ খাদেমুল বাশারের কথায়, ‘‘নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মন খারাপ তো সকলেরই। তার সঙ্গে বড়দিনের ঠিক আগে প্রতিবাদ আন্দোলনেও ব্যবসা মার খাচ্ছে।’’

কী রকম? বাশারসাহেবের ব্যাখ্যা, ‘‘চাঁপাডাঙা, শেওড়াফুলি থেকে কলকাতার দমদম-মানিকতলায় খুচরো দোকানে অনেকেই মাল কিনতে চাইছেন না। অথবা, ঝুটঝামেলায় বাজার মন্দা যাবে ধরে নিয়ে সিকি ভাগেরও কম মাল নিচ্ছেন। এ দিকে, কারখানায় কেকের মালমশলা তো সব কেনা হয়ে গিয়েছে!’’ পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বড়দিনের আগের শেষ বেলায় কারবার কিছুটা সামাল দিতে পারা যাবে বলে আশায় কেক-স্রষ্টারা। ইম্পিরিয়ালের কর্ণধার জাহাঙ্গিরসাহেবও বলছেন, ‘‘গোলমালের জন্য রাস্তাঘাটে অসুবিধায় পড়ে খিদিরপুরের কারখানার মিস্ত্রিরা অনেকেই কয়েক দিন আসতে পারেননি।’’

পশ্চিমবঙ্গ বেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিইও আরিফুল ইসলামের হিসেবে, ‘‘সব মিলিয়ে ব্যবসা অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ ধাক্কা খেয়েছে।’’ রাজ্যে হাজার আড়াই বেকারি কারখানার মধ্যে শ’আড়াই রয়েছে বৌবাজার, তালতলা, পার্ক সার্কাস, শিয়ালদহ, দমদমে। বেকারি মিস্ত্রি বা মালিকদের ৭৫ ভাগ বাঙালি মুসলিম। আরামবাগ মহকুমা থেকে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে কাজ করেন। বছরভর পাঁউরুটি, নানখাটাই, বেকারি বিস্কুটের ব্যবসা চললেও আসল লাভের সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারিই। এ বার ঠিক তখনই নানা গোলযোগে ব্যবসার দফারফা।

আরিফুলের কথায়, ‘‘কলকাতা ছাড়াও খড়্গপুর, দুর্গাপুরের মতো কেকের জায়গার ব্যবসারও হাল খারাপ। হয় জায়গা মতো কেকের জোগান দিতে সমস্যা হচ্ছে, নয়তো নানা দুশ্চিন্তায় তিন চার পুরুষের হুগলিবাসী শ্রমিকেরাও কাজে আসছেন না।’’ রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের কাছে সালদানহাদের বিখ্যাত বেকারির চালিকাশক্তিও উত্তর-দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাঙালি মুসলিম কারিগরেরা। সেখানেও সবার মন খারাপ। তালতলার বাসিন্দা এঞ্জেলা গোমস সম্প্রতি কেকের মালমশলা নিয়ে ‘জ্বালাই’ (বেকিং) করাতে পাড়ার বেকারিতে গিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্লুরিজ়-নাহুমের কেক কেনার সাধ্য নেই। আমাদের আত্মীয়বন্ধুদের ঘরে বড়দিনের কেক পাঠাতে পাড়ার বেকারিই ভরসা। যাঁরা আমাদের মুখে বড়দিনে হাসি ফোটান, সেই কেক-মিস্ত্রিদের মুখ থমথমে। দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে!’’ নাগরিকত্ব আইনে সমাজের একটা অংশকে কার্যত ব্রাত্য করে রাখার যন্ত্রণায়

অনেকের বড়দিনের আমেজই যেন ফিকে হয়ে আসছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Christmas Cake CAA NRC Citizenship Amendment Act
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy