সর্বজনীন: উৎসবের আনন্দে মেতেছেন একদল তরুণী। মঙ্গলবার, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: সুমন বল্লভ
তিনিও ব্রাত্য। বেথলেহেমের দেবশিশুটির ঘর ছিল না জন্মের সময়ে। আস্তাবলে জন্মাতে হয়েছিল তাঁকে। তার পরে তো তাঁকেও উদ্বাস্তু হতে হল। রাজা হেরদের হাতে শিশুমেধ যজ্ঞ শুরুর পরে মা মেরি ও জোসেফ কোলের শিশুটিকে নিয়ে মিশরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মঙ্গলবার বড়দিনের প্রাক্কালে বাইবেলের সেই চিরকেলে গল্প শোনাচ্ছিলেন বেকবাগানের বিশপ্স কলেজের অধ্যক্ষ, রেভারেন্ড সুনীল কেলেব। এর কয়েক ঘণ্টা বাদেই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে মধ্যরাতের প্রার্থনাসভা বসবে। ‘‘এ সব কথা তো প্রতি বড়দিনেই আমরা বলে থাকি। কিন্তু জিশুকে ঘিরে চেনা গল্পগুলোর মানে কেমন পাল্টে যাচ্ছে, এই ২০১৯-এর ভারতে।’’— বলছিলেন সুনীল। তাঁর মতে, ‘‘সদ্যোজাত জিশুর মতোই আমাদের দেশের নাগরিকদের একটা অংশকে ব্রাত্য রেখে নাগরিকত্ব আইন তৈরি হয়েছে, যা কোনও ভাবেই দেশের সংবিধানের আদর্শের সঙ্গে খাপ খায় না।’’ আজ, বুধবার বড়দিনের প্রার্থনায় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের প্রার্থনাসভা পরিচালনার সময়ে সুনীল এ দেশের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা সরাসরি বলবেন না। ‘‘কিন্তু উদ্বাস্তু জিশুর বেদনা অবশ্যই প্রার্থনার সময়ে সবার সামনে তুলে ধরব।’’— বললেন তিনি।
দেশ জুড়ে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রতিবাদী মহামিছিলের দিনে সুনীল সস্ত্রীক দাঁড়িয়েছিলেন ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে। হাতে দেশের সংবিধান। বললেন, ‘‘প্রতিবাদীদের পোশাক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথাটাও খুব খারাপ লেগেছে। তাই ইচ্ছে করে সুট-টাই পরে গিয়েছিলাম। সেটাও প্রতিবাদ!’’ ক্রিসমাস ইভের ‘মিডনাইট মাস’ সন্ত পলের ক্যাথিড্রালে এ বার যিনি পরিচালনা করলেন, চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়ার কলকাতা ও ব্যারাকপুর ডায়োসেসের বিশপ পরিতোষ ক্যানিংও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী অবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। ‘মাস’ শুরুর আগে তিনি বলছিলেন, ‘‘এ বার বিশেষ করে বলতে চাই যে জিশু কিন্তু সবার আগে নিঃস্বদের গলা জড়াতে চেয়েছিলেন।’’ বিশপের উপদেশের ভাষাও এ বার যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী, ‘‘নিঃস্ব মানে যাঁরা অসহায় বাস্তুহারা, পরিচয়পত্রহীন!’’
গত কয়েক দিন ধরেই দেশের নতুন আইনে বিপন্ন মুসলিম ভাইবোনেদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে খ্রিস্টান সমাজের বার্তা এসেছে জনে-জনে। মেঙ্গালুরর ক্যাথলিক খ্রিস্টান তরুণী, পেশায় ডিজ়াইনার কিরণ জোনের তৈরি একটি মিম তো জনে-জনে ছড়িয়ে পড়েছে। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে ম্যাথুর গসপেলের বাণী তাতে উদ্ধৃত। ‘ডু আনটু আদার্স অ্যাজ় ইউ উড হ্যাভ দেম ডু আনটু ইউ’ (অপরের সঙ্গে তেমন ব্যবহার কর, যা তুমি আশা কর অপরের কাছে)। তলায় লেখা, এনআরসি, সিএএ-র বিরুদ্ধে খ্রিস্টানেরা। কিরণ ও তাঁর দিদি অ্যামেল শ্যারনের বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের শিক্ষিকা ঈপ্সিতা হালদার। ঈপ্সিতা বলছিলেন, ‘‘কিরণ, অ্যামেলরা গোঁড়া ধার্মিক নন। তবু ওঁরা মনে করেছেন দেশে নাগরিকত্ব আইনের নামে সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান সমাজের তরফেও একটা বার্তা যাক। ইচ্ছে করেই ধার্মিক খ্রিস্টানদের ভাষায় ওঁরা প্রতিবাদের কথা বলছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পিকনিক গার্ডেনে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের চার্চ অব আওয়ার লেডি অব ভেলেঙ্কানিতে ফাদার মলয় ডি’কস্টার প্রার্থনাসভাও বাংলায় জিশুর ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা সবাইকে কাছে টানার আদর্শের কথা বলল। মলয় বলছেন, ‘‘জিশু কাউকে বাদ দিতে কখনও বলেননি। সবাইকে কাছে টানার কথাই বলেছেন। নতুন আইন জিশুর আদর্শের বিরোধী।’’ চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়ার কলকাতা ডায়োসেসের অর্থসচিব রীতেশ সরকারও এই বড়দিনে পরিচয়পত্র নিয়ে আতঙ্কিত দেশের গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সময়ের দায় বলে মনে করছেন। ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের সভানেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা মানটোশ জসনানির কথায়, ‘‘শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায় নয়। খ্রিস্টান বা অন্য জাতপাতের মানুষকেও ক্রমশ কোণঠাসা করার ঘোর আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি।’’ সবাইকে নিয়ে চলার ভারতীয় সংস্কৃতির কাছে ফেরার তাগিদটুকুও এই বড়দিনের প্রার্থনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy