নারী দিবসেও ব্রাত্য গার্হস্থ্য হিংসা। প্রতীকী ছবি।
নারকেলডাঙা থানার সামনে পুলিশের গাড়ির দরজা ধরে আকুতি করে চলেছেন এক মহিলা। ভিতরে বসা পুলিশকর্মী অনেক বুঝিয়েও তাঁকে দূরে সরাতে পারছেন না। মহিলার পরনের শাড়ি নানা জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছে। কপালের একাংশ ফোলা, চোখের নীচে কালশিটের দাগ। আতঙ্কের ছাপ চোখে-মুখে স্পষ্ট। বলছেন, ‘‘সারা রাত ঘরে ঢুকতে দেয়নি। খুব মেরেছে। আপনারা চলুন। এখনই গ্রেফতার করুন।’’
বুধবার, আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে শহরের একটি থানার সামনে এক মহিলার এমন আকুতি দেখে হঠাৎ তৎপর পুলিশকর্মীরা। মহিলাকে শান্ত করে প্রশ্ন করা হলে জানা যায়, তিন মেয়ের পরে কেন ফের মেয়ের জন্ম দিয়েছেন, সেই ‘অপরাধে’ শ্বশুরবাড়িতে এখনও তাঁকে মার খেতে হয়। কখনও শ্বশুরবাড়ির চাহিদামতো রোজগার করে আনতে না পারায় ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয়। ওই মহিলা বলেন, ‘‘ক’দিন ধরেই ঝামেলা চলছিল। রাস্তায় ঘুরে কাগজ-প্লাস্টিক কুড়োই। সপ্তাহের শেষে প্রতি রবিবার টাকা দেন বাবুরা। এই রবিবার টাকা পাইনি। তাই স্বামী মারতে শুরু করে। এখন ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না।’’ আগে আসেননি কেন? পুলিশকর্মীর কড়া ধমক খেয়ে মহিলার অভিযোগ, ‘‘এসেছিলাম তো! স্যরেরা শুনে বলেছেন, নিজেরা মেটাও। বহু বাড়িতেই বৌ পেটানো হয়। ছোট ছোট সব বিষয়ে ঢুকলে আর দেখতে হবে না!’’
এ দিন অবশ্য আর ‘ছোট বিষয়’ বলে দাগিয়ে দিয়ে ওই মহিলার অভিযোগকে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। বরং মামলা রুজু করে দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই কেন এই পদক্ষেপ করা হয়নি, উঠছে সেই প্রশ্ন। মহিলাদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য থেকে ভুক্তভোগীদের একাংশ— সকলেরই অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই তৎপর হয়ে পদক্ষেপ করে না পুলিশ। থানা অনুযায়ী এই ধরনের অভিযোগের গুরুত্ব ঠিক হয়। পারিবারিক বিষয়ে পুলিশের ঢোকা ঠিক নয়, বহু ক্ষেত্রেই এমন কথা বলে দায় এড়ানো হয়। পুলিশবাহিনীর এক সদস্যও বললেন, ‘‘যে থানা এলাকায় বস্তি বেশি, সেখানে এক ধরনের অলিখিত নির্দেশ দেওয়া থাকে যে, গুরুতর কিছু না ঘটলে স্বামী-স্ত্রী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে মহিলা নিগ্রহের ঘটনায় ঢোকার দরকার নেই। চড়থাপ্পড়ের মতো ‘সামান্য’ কিছু ঘটলে এড়িয়ে যাওয়াটাই বিধি। বড়জোর দু’পক্ষকে ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হবে।’’ উত্তর কলকাতার আর একটি থানার এক পুলিশ আধিকারিক বললেন, ‘‘বুঝিয়েসুঝিয়ে একটু চমকে দিলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ হয়। তবে যে থানা এলাকায় উচ্চবিত্ত মানুষের বাস, সেখানে এমন অভিযোগ এলে তো বাড়তি গুরুত্ব দিতেই হয়।’’
প্রশ্ন উঠছে, এই কারণেই কি ২০২২ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’-র (এনসিআরবি) রিপোর্ট অনুযায়ী, গার্হস্থ্য হিংসার নিরিখে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ? রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের মোট নারী নিগ্রহের ৩১.৮ শতাংশই স্বামী ও তাঁর পরিবারের দ্বারা নির্যাতনের ঘটনা। সমীক্ষা বলছে,২০২১ সালে ৪৯৮এ ধারায় পশ্চিমবঙ্গে মামলা হয়েছে মোট ১৯,৯৫২টি। তবে এ বিচারে মেট্রো শহরগুলির মধ্যে তালিকার নীচের দিকেই রয়েছে কলকাতা। যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বললেন, ‘‘কলকাতার সব থানাকে এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। তার পরেও গাফিলতি হয়ে থাকলে পদক্ষেপ করা হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানের একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। এই রাজ্যের মহিলারা সচেতন, তাই তাঁরা অভিযোগ জানাতে আসেন। মামলা রুজু হয়েছে বলেই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। নতুন বছরে এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।’’
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গার্হস্থ্য হিংসা এই মুহূর্তের একটি গুরুতর সমস্যা। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, যে কোনও চাপেই হোক, থানা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরেও অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের হচ্ছে না বা অভিযোগ তুলে নেওয়া হচ্ছে। মহিলাদেরই বুঝতে হবে, তাঁরা আরও বেশি করে এগিয়ে না এলে এই সমস্যা মিটবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy