Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

টাকা হাতানোর নয়া অস্ত্র ওয়ালেট অ্যাপ

ভরদুপুরে হঠাৎই অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ওপার থেকে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে এক জন বলেন, বিনামূল্যে নতুন ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে তাঁকে। সে জন্য তাঁর মোবাইলে যাওয়া একটি ‘কোড’ নম্বর জানাতে হবে। নতুন কার্ড পেতে ওই ব্যক্তি সেই নম্বর জানিয়ে দেন ফোনের ও-পারে থাকা ব্যক্তিকে। তার পরেই ব্যারাকপুরের বাসিন্দা ওই মাঝবয়সী ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ড থেকে ২১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় জালিয়াতেরা।

অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

ভরদুপুরে হঠাৎই অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ওপার থেকে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে এক জন বলেন, বিনামূল্যে নতুন ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে তাঁকে। সে জন্য তাঁর মোবাইলে যাওয়া একটি ‘কোড’ নম্বর জানাতে হবে। নতুন কার্ড পেতে ওই ব্যক্তি সেই নম্বর জানিয়ে দেন ফোনের ও-পারে থাকা ব্যক্তিকে। তার পরেই ব্যারাকপুরের বাসিন্দা ওই মাঝবয়সী ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ড থেকে ২১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় জালিয়াতেরা।

এমনিতে এমন জালিয়াতি নতুন নয়। কিন্তু এই ঘটনার তদন্তে নেমে দেখা যায়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নয়, এ ক্ষেত্রে জালিয়াতির কেন্দ্রে রয়েছে টাকা লেনদেনের মোবাইল অ্যাপ, পোশাকি ভাষায় যাদের নাম ‘ওয়ালেট অ্যাপস’। যেগুলিতে লেনদেনের পাশাপাশি অ্যাপের অ্যাকাউন্টে টাকা জমিয়েও রাখা যায়। ব্যারাকপুরের ওই ঘটনার তদন্তে ‘পে-টিএম’, ‘মোবিক্যুইক’-এর মতো কিছু ওয়ালেট অ্যাপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তাদের দাবি, ওই অ্যাপ ব্যবহার করেই জালিয়াতির টাকা সরিয়ে নিয়েছে দুষ্কৃতীরা। লালবাজার সূত্রে খবর, আগে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ক্ষেত্রে জাল নথি দিয়ে তৈরি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে টাকা সরাত জালিয়াতেরা। সেই সূত্র ধরে তদন্তে এগোত পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে এই সূত্র ধরেই চক্রের চাঁইদেরও হদিসও মিলেছে। কিন্তু অ্যাপের মাধ্যমে টাকা সরানো হলে সেই সূত্রটি হারিয়ে যায় বলেই গোয়েন্দাদের দাবি। ফলে এই ধরনের জালিয়াতদের ধরতে রীতিমতো নাকাল হতে হচ্ছে গোয়েন্দাদের।

কী ভাবে জালিয়াতি হয় অ্যাপের মাধ্যমে? গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, প্রথমে জালিয়াতেরা বিভিন্ন কার্ড গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের ডেবিট বা ক্রেডি়ট কার্ড নম্বর এবং পিন হাতিয়ে নেয়। তার পরে নেট ব্যাঙ্কিং ব্যবহার করে সেখান থেকে টাকা সরিয়ে নেয় অ্যাপের অ্যাকাউন্টে। লালবাজারের গোয়েন্দারা বলছেন, এই সব অ্যাপে শুধু ব্যবহারকারীর মোবাইল নম্বর থাকে। কিন্তু জালিয়াতেরা ভুয়ো নথি দিয়ে সেই মোবাইলের সিমকার্ড কেনায় অ্যাকাউন্টের তথ্যও ভুয়ো হয়। ফলে তাদের ধরার উপায় থাকে না।

এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করলে জালিয়াতদের সুবিধা কোথায়?

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অ্যাপে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লেনদেন করা যায়, আবার অ্যাপে টাকা জমিয়ে রেখে মোবাইল বা কেব্‌ল টিভি রিচার্জও করা যায়। কিন্তু অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলতে কোনও নথি লাগে না, ব্যবহারকারীর আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হয় না। পুলিশকর্তারা বলছেন, এই সুবিধা কাজে লাগিয়েই পে-টিএম, পে-ইউ, পার্ক ওয়ালেট, মোবিক্যুইক-এর মতো নানা ওয়ালেট অ্যাপকে প্রতারণার হাতিয়ার করছে জালিয়াতেরা। এই চক্রে মোবাইল ও কেব্‌ল টিভি রিচার্জ ব্যবসায়ীদের একাংশের যোগসাজশও মিলেছে
বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। লালবাজার সূত্রের খবর, মার্চ-এপ্রিলে শুধুমাত্র কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগেই প্রায় ৪০টির মতো এমন অভিযোগ
জমা পড়েছে।

লালবাজার সূত্রে খবর, হরিদেবপুর ও পর্ণশ্রী এলাকার দু’টি ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্তে নেমে প্রথমে পুলিশ এই ছকের কথা জানতে পারে। সেই সূত্রেই ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া থেকে একটি দলকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরেও ওই এলাকার আরও কয়েকটি দলকে পাকড়াও করেন অন্যান্য রাজ্যের গোয়েন্দারা। যার পরে প্রথম রাজ্যের নামেই ওই জালিয়াতি চক্রের নাম হয়েছে ঝাড়খণ্ড গ্যাং। কলকাতা পুলিশের এক গোয়েন্দার কথায়, ‘‘সারা দেশে পুলিশের খাতায় এই জালিয়াতির মূল চক্রী ঝাড়খণ্ড গ্যাং।’’

লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, ঝাড়খণ্ড গ্যাংয়ের সদস্যদের ধরপাকড়ের ফলে কয়েক দিন এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় লাগাম টানা গিয়েছিল। কিন্তু চলতি মাস থেকে ফের এমন জালিয়াতির ঘটনা শুরু হয়েছে। যা দেখে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, এই গ্যাংয়ের অনেকে এখনও পুলিশের নাগালের বাইরে রয়েছে। কিংবা ঝাড়খণ্ড গ্যাংয়ের ‘বিদ্যা’ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যত্রও!

বস্তত, স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে অ্যাপের চাহিদাও বেড়েছে। ব্যাঙ্ক পরিষেবা হোক কিংবা রেল-বিমানের টিকিট বুকিং—সব কিছুতেই এই ধরনের অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার বাড়ছে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময়ই স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা রক্তচাপ মাপা কিংবা ফোন নম্বর ট্র্যাকারের মতো অ্যাপ ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে এগুলিই গ্রাহকদের তথ্য হাতিয়ে নেয়। যা যেতে পারে জালিয়াতদের হাতেও। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, ব্যাঙ্কের অ্যাপকে স্বীকৃতি দিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লোগো ব্যবহার করার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ইদানীং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লোগো জাল করে তৈরি হচ্ছে বহু ভুয়ো অ্যাপ!

প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের জালিয়াতি রুখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কিছু করছে কি?

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবশ্য এই ধরনের জালিয়াতি রোখার দায় চাপিয়েছে পুলিশের উপরেই। তারা জানিয়েছে, সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। বস্তুত, ব্যাঙ্ক এবং ব্যক্তিগত তথ্য কারও কাছে না জানানোর জন্য ব্যাঙ্ক ও পুলিশ নিয়মিত এসএমএস পাঠিয়ে সচেতন করে। পাশাপাশি, অবাঞ্ছিত ও অজানা অ্যাপ ব্যবহার না করতে পরামর্শ দেন সাইবার বিশেষজ্ঞরাও। তা সত্ত্বেও সচেতনতায় ঘাটতি রয়েছে বলে তাঁদের দাবি। সাইবার ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অ্যাপ ব্যবহার নিয়ে মানুষ সচেতন না হলে এই অপরাধ ঠেকানো মুশকিল। অ্যাপ ব্যবহার করতে হলে বড় কোম্পানির তকমা দেওয়া অ্যাপস ব্যবহার করা উচিত।’’

আর কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলছেন, ‘‘অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত তো করবই। কিন্তু সাধারণ মানুষেরই নিজের ব্যাক্তিগত তথ্যের বিষয়ে বেশি করে সতর্ক থাকা উচিত। ব্যাঙ্কেরও প্রয়োজনে বিভিন্ন নিয়মের ক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপ করা উচিত।’’ লালবাজার সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই এই সব বিষয় নিয়ে একাধিক ব্যাঙ্ককর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন পুলিশের কর্তারা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE