অসচেতন: উল্টোডাঙা নতুনবাজারে জিনিস মজুত করতে ভরসা প্লাস্টিক ও প্যাকিং বাক্স।ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছে আগে। ফের বিপদের আশঙ্কা ষোলো আনা। তবু আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগই নেই সে ভাবে! এটাও জানা নেই যে মোক্ষম সময়ে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কাজ করবে কি না! বাগড়ি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বাজারগুলির এই চেহারা।
শহরের অনেক বাজারই বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থাকলেও সুরক্ষা আজও বাড়েনি। বরং বেশির ভাগই কার্যত জতুগৃহ। কোথাও অগ্নিকাণ্ডের পরে ছ’বছর কেটে গেলেও আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা হয়নি। কোনওটিতে আবার পুরনো নির্মাণ এবং বিদ্যুতের তারের জটে দমবন্ধ অবস্থা। দমকলের গাড়ি ঢোকা তো দূর, ক্রেতাদের যাতায়াতের পর্যাপ্ত পথও নেই। উল্টোডাঙা নতুনবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাজু সাহার আক্ষেপ, ‘‘বাগড়ি মার্কেটের মতো আগুন লাগার অভিজ্ঞতা আমাদেরও রয়েছে। সব জেনেও কিছু করার নেই। যেন নিধিরাম সর্দার!’’
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, বেসরকারি বাজারগুলির উপরে পুরসভার সেই অর্থে কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। ফলে হাতিবাগান বাজার, নন্দরাম মার্কেট, সূর্য সেন মার্কেট, রানি রাসমণি বাজার, যদুবাবুর বাজারে আগে আগুন লাগলেও সেই অর্থে কোনও পদক্ষেপই করতে পারেনি পুরসভা। তথ্য বলছে, কলকাতা পুরসভার অধীনস্থ বাজারের সংখ্যা ৪৬টি। বেসরকারি বাজারের সংখ্যা ৩১৪টি। পুর এলাকার মোট বাজার ৩৬০টি। এই সব হিসেবের বাইরেও রয়েছে অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থাকা পার্শ্ববর্তী পুর এলাকার আরও এক বাজার, দমদমের গোরাবাজার।
দমদম গোরাবাজারে সঙ্কীর্ণ যাতায়াতের পথ।
শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানির পরে রাজ্য সরকার শহরের বাজারগুলি পরিদর্শনের জন্য বিশেষ দল গড়ে। পাঁচ বছর আগে বাজারগুলি ঘুরে ওই দল যে রিপোর্ট দেয় তাতে ভয়াবহ ছবি উঠে আসে। রিপোর্টের ভিত্তিতে পুর বাজারগুলিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে পুরসভা। সমস্যা দেখা দেয় বেসরকারি বাজার নিয়ে। দলের এক সদস্যের কথায়, ‘‘বেসরকারি বাজারগুলির ভয়াবহ অবস্থা। সেখানে ভিডিয়োগ্রাফি করতে গিয়েও বাধা পেয়েছিলাম।’’ ওই দলেরই আর এক সদস্য রবীন্দ্রনাথ কোলে বলেন, ‘‘বেসরকারি বাজারগুলি নিয়ে অনেক বার আলোচনা হয়েছিল। বাজার মালিকদের সতর্কও করা হয়েছিল।’’ পুর আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে বিপজ্জনক এবং ঘিঞ্জি বাজারগুলিকে চিহ্নিত করে ১১৩টি গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়। তার তালিকাও পুরসভার জল সরবরাহ দফতর, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতি, দমকল-সহ সকলের কাছে পাঠানো হয়। সেগুলি এখন কাজ করে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন কেউই!
হাতিবাগান বাজারে একটি জায়গায় রাখা রয়েছে সমস্ত অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র।
ছ’বছর আগে পুড়ে গিয়েছিল হাতিবাগান বাজার। ওই বাজারে এখন প্রায় ৭৫০টি দোকান রয়েছে। ঢোকা-বেরোনোর পথও অপরিসর। ওই অগ্নিকাণ্ডের পরে গভীর নলকূপ বসানো হলেও সেখান থেকে জল তোলার জন্য পাইপ বসানো যায়নি এত দিনেও। ‘হাতিবাগান বাজার মার্চেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি রঞ্জন রায় বলেন, ‘‘বাজারের দিকেই নলকূপ বসানোর জায়গাটা ভুল হয়েছে। পাইপ দিয়ে জল নেওয়া তো দূর, আগুন লাগলে বিদ্যুৎ সংযোগই কেটে যাবে! তখন পাম্প চালিয়ে জল উঠবে কী ভাবে?’’
রানি রাসমণি বাজারে তারের জট।
একই সমস্যা দক্ষিণ কলকাতার যদুবাবুর বাজারেও। একাধিক বার অগ্নিকাণ্ডের পরেও পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই এই বাজারে। ‘‘গত বছর বাজারের মধ্যেই জলাধার তৈরি হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।’’— বলছেন ‘যদুবাবু বাজার ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক ভানুদেব বিশ্বাস। তিনি আরও বললেন, ‘‘আমাদের বাজারের বড় সমস্যা বৈদ্যুতিক তারের জট। প্রশাসনে বলেও সেই সমস্যা মিটছে না।’’ জানবাজারের রানি রাসমণি মার্কেট আবার রাস্তার দু’ধারে ফুটপাত দখল করেই চলছে দিনের পর দিন। পুরসভার এই বাজার নিয়েও রয়েছে মাথাব্যথা। বেশির ভাগই বিপজ্জনক বাড়ির নীচে হওয়ায় বড় বিপদ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ‘জানবাজার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনে’র সহ-সম্পাদক মদন গুপ্ত বলছেন, ‘‘বিপদ রয়েছে জানি। তবে বললেই তো ২০০ দোকানদারকে ফুটপাত থেকে সরানো যায় না।’’
কলকাতা পুরসভার এক কর্তা বলেন, ‘‘কোনও ঘটনা ঘটলে তার পরে তো অনেক কিছুই করা হয়। পরে সেগুলির কী হয়, সেটা খোঁজ রাখা যায় না। বাজার ব্যবসায়ী সমিতিরও দায় থাকে সেই সব ব্যবস্থার দেখভাল করা।’’ গাফিলতির কথা মেনে কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) আমিরুদ্দিন ববি বলেন, ‘‘কিছু কাজ বাকি রয়েছে ঠিকই, সমস্যা দেখে সব ব্যবস্থা করা হবে।’’
ব্যবস্থা হওয়ার আগেই বিপদ ঘটলে উপায়? উত্তর নেই কোনও পক্ষের কাছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy