Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Crime

হিন্দু মেয়ের সঙ্গে ফুর্তি করছিস? এই বলেই দাড়িওয়ালা যুবককে মার নাগেরবাজারে, হেনস্থা বান্ধবীকেও

সমস্ত ঘটনার আতঙ্ক এতটাই দানা বেঁধে ছিল যে, ওঁরা কোথাও অভিযোগ জানানোয় ভরসা পাননি বলে জানিয়েছেন জয়দীপ-মৈত্রেয়ী।

যুগলকে মারধর করার অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র।

যুগলকে মারধর করার অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৯ ২০:৩৫
Share: Save:

গাল ভর্তি দাড়ি যুবকের। সঙ্গে এক যুবতী। দু’জনেই মদ্যপান করে সিগারেট খাচ্ছিলেন একটি পানশালার পাশের গলিতে। যুবকের দাড়ি দেখে এলাকার মানুষের সন্দেহ হয়, তিনি মুসলমান। সেই ‘অপরাধে’ই এক যুবক এবং তাঁর সঙ্গীকে মারধর করার অভিযোগ উঠল খাস কলকাতার বুকে। গোটা ঘটনায় পুলিশ ওই যুগলকে সাহায্য করা দূরে থাক, উল্টে ওই যুবক-যুবতীকেই পুলিশের কটুক্তির মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

মুখে দাড়ি দেখে মুসলমান বলে মারধরের অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদেরই এক জন জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ির গ্যারাজের কাছে দাঁড়িয়ে অশালীন কাজকর্ম করছিলেন চার যুবক-যুবতী। তার প্রতিবাদ করায় উল্টে এই যুবক-যুবতীই তাঁদের আক্রমণ করে। বাকি দু’জন পলিয়ে যান।

গত শনিবার রাতে বছর তিরিশের জয়দীপ সেন তাঁর বান্ধবী মৈত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েছিলেন নাগেরবাজার এলাকার একটি পানশালাতে। তেইশ বছরের মৈত্রেয়ী উচ্চশিক্ষার সুবাদে ইংল্যান্ডে থাকেন। বৃহস্পতিবার ওই দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মৈত্রেয়ী বলেন, ‘‘ওই পানশালায় সে দিন আমরা রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত মদ্যপান করি। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা পানশালার পাশের একটা গলিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম।” জয়দীপ জানান, ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। তিনি বলেন, ‘‘সবে সিগারেট ধরিয়েছি, মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি হঠাৎ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। তারপরই অশালীন ভাষায় কটূক্তি করেন। মৈত্রেয়ীর দাবি, ‘‘জয়দীপদা আমাকে নিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তখন আমি রাগ চাপতে না পেরে ওই লোকটাকে একটা গালি দিই।”

দমদম থানায় বুধবার অভিযোগ জানাচ্ছেন জয়দীপ ও মৈত্রেয়ী। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: ছ’মাসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চাঙ্গা তৃণমূল, তোলপাড় শুরু বিজেপিতে, এনআরসির পরোক্ষ শিকার বাম-কংগ্রেসও​

জয়দীপ-মৈত্রেয়ী জানিয়েছেন, এর পরই ওই ব্যক্তি চিৎকার জুড়ে দেন। মৈত্রেয়ীর কথায়, ‘‘লোকটি আমার দিকে এর পর তেড়ে আসে মারতে। আমার বুকে ধাক্কা মারে। এর পর তিনি আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি নিজেকে ছাড়াতে যাই। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়।” ওই যুগলের দাবি, ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। জয়দীপের অভিযোগ, ওই ব্যক্তি এর পর চিৎকার শুরু করেন। আশপাশ থেকে বেশ কয়েক জন বেরিয়ে আসেন। তাঁরা জয়দীপ-মৈত্রেয়ীকে ঘিরে ধরেন। অভিযোগ, তাঁদের দু’জনের উদ্দেশে শুরু হয় অকথ্য গালিগালাজ, সঙ্গে মারধর।

মারতে মারতে ওই লোকগুলো তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করে— এমনটাই জানাচ্ছেন জয়দীপ-মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ীর কথায়, ‘‘আমি পুরো নামই বলি। জয়দীপদা পদবি ছাড়া নাম বলে। জয়দীপদার গালে দাড়ি ছিল। শুধু নাম বলায় ওরা ধরে নেয় জয়দীপদা মুসলমান।” জয়দীপ বলেন, ‘‘আমাকে ওরা বার বার বলতে থাকে মুসলমান হয়ে আমি ব্রাহ্মণের মেয়েকে মদ খাইয়ে ফুর্তি করছি।” সেই সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মৈত্রেয়ী এ দিন বলছেন, ‘‘তত ক্ষণে কয়েক জন মহিলাও বেরিয়ে এসেছেন। আমাকে মারতে থাকেন তাঁরা। বলতে থাকেন, কেন আমি মেয়ে হয়ে মদ খেয়েছি, সিগারেট খেয়েছি!”

জয়দীপ-মৈত্রেয়ীর দাবি, প্রায় আধ ঘণ্টা পর পুলিশ এসে পৌঁছয়। আমাদের গাড়িতে তুলে নেয়। মৈত্রেয়ী এ দিন বলেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম পুলিশ আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, যারা আমাদের মারছিল, তারাই পুলিশে খবর দিয়েছে। কিন্তু কামারডাঙা ফাঁড়িতে যাওয়ার পর ভুল ভাঙল। দেখলাম পুলিশও ঠিক একই ভাষায় আমাদের কটূক্তি করছে। আমাদের ফোন, পাসপোর্ট সব কেড়ে নেয় পুলিশ। কোনও শারীরিক পরীক্ষা না করেই স্থানীয় হাসপাতালে পুলিশের কথা মতো হয়ে যায় মেডিক্যাল টেস্ট!”

আরও পড়ুন: এনআরসি আতঙ্ক থেকে বেহাল অর্থনীতি, গোটা দেশের খণ্ডচিত্র রাজ্যের উপনির্বাচনে? উঠছে প্রশ্ন​

তত ক্ষণে পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছন জয়দীপ-মৈত্রেয়ীর বাবা ও পরিবারের লোকজন। তাঁদেরকে সাদা কাগজে সই করিয়ে ৬০০ টাকা নিয়ে দু’জনকেই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে পুলিশ। মৈত্রেয়ীর দাবি, ‘‘ আমি পুলিশকে বলি, যারা আমাদের মারল, আমার সোনার হার ছিনিয়ে নিল তাদের বিরুদ্ধে আমিও অভিযোগ জানাব এবং সেই অভিযোগ নিতে হবে।” অভিযোগ, মৈত্রেয়ীর সেই কথা শুনেই তেড়ে ওঠেন পুলিশ অফিসার এবং দু’জনকেই লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফেরেন ওঁরা। পরের দিন সমস্ত ঘটনার আতঙ্ক এতটাই দানা বেঁধে ছিল যে, ওঁরা কোথাও অভিযোগ জানানোয় ভরসা পাননি বলে জানিয়েছেন জয়দীপ-মৈত্রেয়ী। তবে পরের দিন অর্থাৎ সোমবার নিজেদের ওই ভাবে মার খাওয়ার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন মৈত্রেয়ী। জয়দীপও তাঁর অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে জানান।

এ দিন জয়দীপ বলেন, ‘‘আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হতেই দমদম থানার আইসি-র ফোন পাই। তিনি মৈত্রেয়ীর বাবার মোবাইলে ফোন করেন। নম্বরটি ওই রাতে থানায় দিয়ে আসা হয়েছিল। দমদম থানার আইসি আমাদের দু’জনকে যেতে বলেন থানায়। বুধবার রাতে সেখানেই আমরা অভিযোগ দায়ের করি।’’ কিন্তু তার পরেও হেনস্থা একটুও কমেনি দু’জনের, বলছেন জয়দীপ-মৈত্রেয়ী। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘ফেসবুকে গোটা ঘটনা জানিয়ে পোস্ট করার পর থেকেই আমাকে ধর্ষণ এবং খুন করার হুমকি দিয়ে পোস্ট আসছে। তারই মধ্যে আমার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে পোস্ট করে আমাকে ট্যাগ করেন সঞ্জীব সাহা নামে এক ব্যক্তি। ছবি দেখেই চিনতে পারি তাঁকে। ওই ব্যক্তিই সে দিন আমাদের মারধর করা শুরু করেছিল।”

আরও পড়ুন: ঘাসফুল ঝড়ে উড়ে গেল পদ্ম, খড়্গপুর-কালিয়াগঞ্জ ছিনিয়ে নিল তৃণমূল, করিমপুরে বাড়ল ব্যবধান

ফেসবুকে পাল্টা নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন সঞ্জীব সাহা নামে ওই ব্যক্তি। তিনি লিখেছেন, ‘‘চার জন যুবক-যুবতী আমার বাড়ির পিছনে গ্যারাজের কাছে দাঁড়িয়ে মদ্যপান করছিল। অশালীন কার্যকলাপ চলছিল। মা এবং আমি প্রতিবাদ করি। তাদের ওখান থেকে চলে যেতে বলি। তারা আমাদের পাল্টা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আক্রমণ করে। আমি প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্য চাই। তাঁরা এলে, দু’জন পালিয়ে যায়। বাকি দু’জনকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিই।” ফেসবুকেই তিনি দাবি করেছেন, ‘ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে আসল ঘটনা চাপা দিতে চাইছে ওই যুবক যুবতী।”

যদিও এ বিষয়ে জয়দীপ-মৈত্রেয়ীকে প্রশ্ন করলে তাঁরা জানান, পানশালাতেই আরও দু’টি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তাঁদের আলাপ হয়। কিন্তু তাঁরা ঘটনার অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। জয়দীপ বলেন, ‘‘আমরা রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারও ব্যক্তিগত জায়গায় ছিলাম না।’’

ওই পোস্টের সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গিয়েছে, সঞ্জীব সাহা দক্ষিণ দমদম পুরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এলাকা সূত্রে খবর, সঞ্জীব ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অভিজিৎ মিত্রের ঘনিষ্ঠ। তবে ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চেয়ে অভিজিৎবাবুকে বেশ কয়েক বার ফোন এবং এসএমএস করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসেরও।

তবে, দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পাঁচুগোপাল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কর্মী হলে চিনতাম। ওই নামে এই এলাকায় কোনও কর্মী আছেন বলে মনে করতে পাচ্ছি না।” অন্য দিকে গোটা বিষয় নিয়ে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি জোন (২) আনন্দ রায়কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘ওই দু’জন অভিযোগ দায়ের করেছেন। আমরা তদন্ত শুরু করেছি।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy