Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।
Corona

সমালোচনা হোক, কিন্তু প্রশংসাও কি প্রাপ্য নয়

অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।

আমন সিং
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৫:২৪
Share: Save:

গত দেড়টা বছর ম্লান করে দিয়েছে পিছনে ফেলে আসা সাড়ে তেইশটা বছরের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে। কখনও কারও জীবন রক্ষার চেষ্টায়, আবার কখনও কাউকে শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হুটার বাজিয়ে ছুটে চলেছি আমরা।

কলকাতা পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স সহায়ক পদের চুক্তিভিত্তিক কর্মী আমি। পাঁচ বছর আগে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এখন অবশ্য কাজের পরিধি ও গুরুত্ব, দুই-ই বেড়েছে অনেকটা। কোভিড-অ্যাম্বুল্যান্স ও শববাহী গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে মাঝেমধ্যে অবসাদ আসে। আরও কষ্ট হয়, যখন চার দিক থেকে শুধুই সমালোচনা শুনি, প্রশংসা নয়। অথচ সামনে এগোতে দুটোই জরুরি। সমালোচনা যদি অ্যান্টিবায়োটিক হয়, প্রশংসা তবে ভিটামিন। দীর্ঘদিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। মনের সেই ক্ষত নিয়েও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কী কী জমছে, আজ দু’-একটা বলব।

গত বছরের ১ এপ্রিল। এন আর এস হাসপাতাল থেকে সম্ভবত প্রথম করোনা রোগীর দেহ নিয়ে ধাপায় ঢুকেছিল আমাদের গাড়ি। স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ আর সৎকারে বাধার সামনে পড়ে মাথা ফেটেছিল আমাদের ছেলেদের এবং ইন-চার্জ দাদার। নিমতলায় এমন বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলাম আমি। এমন অসংখ্য বাধা টপকেছি প্রথম পর্বে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে অফিস আর পুলিশ সব সময়ে পাশে থাকে।

প্রথম দিকে শুনতে হত, আমরা রোগী না নিয়ে চলে আসি। এই কাজের প্রক্রিয়াটা সংক্ষেপে বলছি। স্বাস্থ্য ভবন থেকে বার্তা আসে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের সদর দফতরে। আমাদের সেই মতো নির্দেশ দেওয়া হয়। একটি অ্যাম্বুল্যান্সের কাছে হয়তো পাঁচটি ঠিকানা এসেছে। এক জন রোগীর কাছে গিয়ে যখন আধ ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করতে হয়, তখন অন্যদের ক্ষেত্রে সেই সময়টাই অমূল্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে কথা ওই রোগীর পরিবারকে বললে দুর্ব্যবহার জোটে। এখন তাই থানার সাহায্য নিয়ে থাকি।

পিপিই পরে ৬-১০ ঘণ্টা টানা ডিউটি করতে হয়। গত বছরের এপ্রিল-মে নাগাদ গরফা থানা এলাকা থেকে এক রোগীকে এম আর বাঙুরে নিয়ে যাওয়ার ডাক আসে। রোগীর বাড়ির পথে রেড রোডে গাড়ি থামাতে হয়েছিল। কারণ, চালক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁকে পিপিই খুলিয়ে ধাতস্থ করেছিলাম। অফিসে খবর দিলে আর এক চালক দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে আসেন।

আরও দুটো গল্প বলি। একটা গত বছরের মে মাসের ঘটনা। একের পর এক রোগী তুলতে তুলতে তেষ্টায় তখন জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। পিপিই-র কথা ভুলে জল চেয়ে বসেছিলাম এক রোগীর প্রতিবেশীর থেকে। বারান্দা থেকে তিনি বললেন, ‘না দাদা, জল দিতে পারব না’। আরও এক ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে বেশি। বারান্দা বা জানলা থেকে চাবি দিয়ে আমাদেরই দরজা খুলে রোগীকে নিয়ে যেতে বলেন অন্য সদস্যেরা, যাঁরা কোভিড নেগেটিভ। তখন কষ্ট হয় সেই মানুষটার কথা ভেবে, যিনি বুকে আগলে বড় করেছেন সন্তানকে। অতিমারি চলে যাবে, আপনার পরিচয় কিন্তু থেকে যাবে। তাই অনুরোধ, ওঁদের তুচ্ছ করবেন না।

আশ্চর্য, বাবা-মায়েরা তবু এমনই থাকেন। যেমন আমার মা। এখনও আমি বাড়িতে ঢোকার সময়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজে আমাকে এবং সঙ্গের জিনিসে স্যানিটাইজ়ার স্প্রে করে দেন। গত বছর সংক্রমিত হয়ে সেফ হোমে গিয়ে ছিলাম আমি। কারণ, বাড়িতে বাবা-মা আর ৯০ বছরের দাদু আছেন। ফড়িয়াপুকুরে আমাদের ভাড়া বাড়িতে বারান্দা নেই। জানলা আছে। তবে সব জানলা দিয়ে এখনও চাবি ঝোলে না, সেটাই রক্ষে।


(লেখক একজন অ্যাম্বুল্যান্স ও শববাহী গাড়ির সহায়ক)

অন্য বিষয়গুলি:

Corona Ambulance coronavirus COVID 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy